তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে নতুন বিপ্লব ঘটেছে বাংলাদেশে। এগিয়ে চলা বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তথ্যপ্রযুক্তি খাত। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে ২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে বর্তমান সরকার। ক্ষমতার ১৪ বছরে বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল। প্রযুক্তির বদৌলতে প্রতিটি ঘরে ঘরে এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া। মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে হাতের মুঠোয় বিশ্ব। বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংকটে যখন গোটা বিশ্ব বিচ্ছিন্ন, মানুষে মানুষে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়েছিল ইন্টারনেট। ডিজিটাল প্রযুক্তি কল্যাণে দেশের জনগণ করোনা মহামারিতেও সংযুক্ত থাকতে পেরেছে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, আদালত, সরবরাহ ব্যবস্থা এমনকি বিচারিক কাজ সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধ ও মোকাবিলায় সতর্ক বার্তা প্রচারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রযুক্তি। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে ডিজিটাল সেবা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেই ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে সেবা নিচ্ছে মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে প্রযুক্তি সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করছেন আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলমের দক্ষ নেতৃত্বে যে কোনো সেক্টরের চেয়ে আইটি খাতে সাফল্য এসেছে বেশি। যা দেশ-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমান প্রজন্মতে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার নানা কর্মসূচি পালন করছে। সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে পারলেই প্রযুক্তিময় বিশ্বে বাংলাদেশ অবস্থান দৃঢ় করতে পারবে।
২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর একনেকে অনুমোদনের পর প্রথম পর্যায়ে ২০১৫-২০১৯ মেয়াদে সারা দেশে আট হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়। ২০২০-২০২৩ মেয়াদে সারা দেশে আরও পাঁচ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব এবং ৩০০ শেখ রাসেল স্কুল অব ফিউচার প্রতিষ্ঠার কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এর মূল উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে— শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের আইসিটি ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তোলা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী মানবসম্পদ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তোলা। প্রতিটি ল্যাবে ১৭টি ল্যাপটপ, একটি এলইডি স্মার্ট টিভি, ওয়েব ক্যামেরা, প্রিন্টার, ল্যান কানেকশন সেটিং মাল্টিপ্লাগ, রাউটার, স্ক্যানারসহ মোট ২৩টি আইসিটি সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব সমূহের স্থায়ীভাবে সাইবার সেন্টার প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও আইসিটি ক্লাব হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে, ফলে ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত স্থাপনের মাধ্যমে এলাকার তরুণ-তরুণীরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে। শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের কারণে সারা দেশে আইসিটি নির্ভর তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠছে। প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসার মাধ্যমে দেশ-বিদেশ থেকে অর্থ উপার্জন করছেন শিক্ষার্থীরাও। শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প (২য় পর্যায়) বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করছেন প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর সূত্র মতে, ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পের (২য় পর্যায়) আওতায় প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় তরুণ-তরুণীদের আইসিটি ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশের পাঁচ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৭টি উন্নতমানের ল্যাপটপ, প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির সমন্বয়ে পাঁচ হাজার ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি সমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে পরিবর্তিত শিক্ষা বিজ্ঞান, ভবিষ্যৎ শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়ন, মৌলিক চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে সারা দেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে একটি করে ৩০০টি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘শেখ রাসেল স্কুল অব ফিউচার’ স্থাপন করা হয়েছে। স্মৃতি বিজড়িত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শোকাবহ ইতিহাস সম্পর্কে সারা দেশের লাখো ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, তরুণ-তরুণীসহ সাধারণ জনগণের কাছে উপস্থাপন, উজ্জীবিতকরণ, অবহিতকরণ ও আগ্রহীকরণের লক্ষ্যে সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ স্থাপন করা হয়েছে। আগামী ১৮ অক্টোবর জাতীয়ভাবে দেশব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজনে ‘শেখ রাসেল, নির্মলতার প্রতীক, দুরন্ত প্রাণবন্ত নির্ভীক’ প্রতিপাদ্যে শেখ রাসেল দিবস পালন-উদযাপন করা হবে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে সারা দেশের পাঁচ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপিত ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ এবং ৩০০টি ‘শেখ রাসেল স্কুল অব ফিউচার’ উদ্বোধন করবেন।
উদ্ভাবনী সংস্কৃতিকে বেগবান করতে ১৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয় ইনোভেশন হাব তৈরি করা হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে নাগরিক সমস্যা বাস্তবায়নযোগ্য সমাধান তৈরি করা হচ্ছে এবং অন্য প্রকল্পটি চলমান রয়েছে এবং ৯৬টি প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। দ্বীপ জেলা কক্সবাজারের মহেশখালীর মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে সরকার ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে তিনটি ইউনিয়নের ২৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রকল্প হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সোলার প্যানেল ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনলাইন স্কুল সিস্টেমের মাধ্যমে ইংরেজি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে।
আইসিটি বিভাগ সূত্র মতে, দেশের প্রতিটি নাগরিক এখন প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করছে। প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে তথ্য কেন্দ্রের সব ধরনের সরকারি সুবিধা পাচ্ছে জনগণ। এখন আর কোনো তথ্যের জন্য নাগরিককে ঘুরতে হয় না। সরকারি সব দপ্তরের তথ্য ও সেবা পাওয়া যায় সংশ্লিষ্ট ওয়েব সাইটের মাধ্যমে। এ টু আইয়ের মাধ্যমে সরকারি সব দপ্তরের প্রায় (যেমন, মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ইউপি কার্যালয়) ১৮ হাজার ওয়েট সাইট তৈরি করা হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতিটি নাগরিক সরকারি সব ধরনের তথ্য ও সেবা ঘরে বসেই নিতে পারছে।
দেশে প্রায় সাড়ে ছয় হাজারের বেশি ডিজিটাল সেবাকেন্দ্র থেকে মাসে গড়ে প্রায় ৬০ লাখ নাগরিক সেবা নিয়ে থাকেন। আর এসব ডিজিটাল সেন্টারে প্রায় ১৩ হাজার উদ্যোক্তা কাজ করছেন। যাদের মধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি নারী উদ্যোক্তা। দুর্গম দ্বীপ ও পাহাড়ি অঞ্চলে ডিজিটাল সেবা নিশ্চিতের উদ্যোগ নিয়েছে আইসিটি মন্ত্রণালয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল ইকোনমিক হাব করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে গত ১৪ বছরে অর্জিত স্বীকৃতি ও সম্মাননা পেয়েছে বাংলাদেশ। হংকংয়ে আন্তর্জাতিক ব্ল্যাক সাইন অলিম্পিয়াড ২০২০ এর প্রথম আয়োজনে মোট ৯টি পুরস্কারের মধ্যে বাংলাদেশের তরুণরা দুটি পুরস্কার লাভ করে। আগামী বছর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ব্লকচেইন অলিম্পিয়াড আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়। দেশব্যাপী ই-মিউটেশন উদ্যোগ বাস্তবায়নের স্বীকৃতি হিসেবে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে ইউনাইটেড নেশনস পাবলিক সার্ভিস ২০২০ পেয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর সূত্র মতে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন, শোভন কাজ সৃজন এবং ই-সার্ভিস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে অধিদপ্তর।
এর মধ্যে সারা দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে যথাযথ অবকাঠামো সৃষ্টি করা, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধন, গবেষণা, নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং প্রয়োগে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান, দপ্তরে ই-গভর্নেন্স কার্যক্রম বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তা প্রদান, সরকারের সব পর্যায়ে আইসিটির ব্যবহার ও প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ এবং সমন্বয় সাধন, মাঠপর্যায়ে সব সরকারি দপ্তরে ওয়েবপোর্টাল ও নেটওয়ার্ক সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং জেলা-উপজেলা, ইউনিয়নপর্যায়ে ইতোমধ্যে স্থাপিত ডিজিটাল কেন্দ্রসমূহে যথাযথ তথ্য সরবরাহ, সংরক্ষণ, হালনাগাদকরণ, ওয়েবপোর্টাল চালু রাখতে কাজ করে অধিদপ্তর।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দেশকে অগ্রগামী করে তুলতে ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে আসছে। বিসিসি সরকারিপর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়ন, ই-গভার্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা, কানেক্টিভিটি স্থাপন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইসিটি সক্ষমতা উন্নয়ন, আইসিটি শিল্পের উন্নয়ন, আইসিটিতে বাংলা ভাষার উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ ব্রান্ডিং এবং সর্বোপরি দেশে উদ্ভাবনী ও স্টার্টআপ সংসড়ৃতির উন্নয়নে কাজ করছে।