ভুয়া অডিট রিপোর্টে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। রিটার্ন জমা দেয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে বড় একটা অংশই ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দেয়। দীর্ঘদিন ধরেই তা চলছে। ভুয়া তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে তৈরি করা ওসব অডিট রিপোর্টের কারণে কোম্পানিগুলোর প্রকৃত আয়ের চিত্র পাওয়া যায় না। মূলত কর ফাঁকি দেয়ার জন্য ওসব প্রতিষ্ঠান এমন অনৈতিক কাজ করে থাকে।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় ভুয়া অডিট রিপোর্ট চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে এখনো ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দেয়া বন্ধ হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এনবিআর ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড তিন লাখ এক হাজার ৬৩৪ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করলেও ২৮ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল। আর চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম দুই মাসেও রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩১৯ দশমিক ৪৪ কোটি টাকা। সেজন্য পরিকল্পনার ঘাটতি, বকেয়া পাওয়া আদায়ে ব্যর্থতা, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়কে দায়ী করা হচ্ছে।
তবে এর সাথে নিরীক্ষকদের নেতিবাচক ভূমিকাও জড়িত। প্রতি অর্থবছরে ভুয়া অডিট রিপোর্টে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের ভুয়া তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে ভুয়া অডিট রিপোর্ট। অডিট রিপোর্ট দেয়ার যোগ্যতা রাখা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা বছরে ২২ হাজার প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। ওই হিসাবে ২২ হাজার প্রতিষ্ঠানের বৈধ অডিট রিপোর্ট থাকার কথা থাকলেও এনবিআরের কাছে রিটার্ন জমা দেয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৫ হাজার।
অর্থাৎ ৩৩ হাজার প্রতিষ্ঠানই এনবিআরের কাছে ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দিচ্ছে। দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) নিরীক্ষকদের শিক্ষা এবং মান সংরক্ষণের ব্যাপারে সার্বক্ষণিক নজরদারির দায়িত্ব রয়েছে। সংস্থাটি হিসাব ও নিরীক্ষার সঠিক মান নিয়ন্ত্রণে নিরীক্ষকদের জন্য মান, আইন ও বিধি তৈরি করে।
সম্প্রতি নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগে ৪৩টি নিরীক্ষা ফার্মের ৫০ নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে কাজের গুণগত মান তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ফাইন্যানশিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) পক্ষ থেকে আইসিএবিকে চিঠি দেয়া হয়।
তাতে বলা হয়, ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেমের (ডিভিএস) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অত্র দপ্তর থেকে যে ৫০ জন নিরীক্ষকের নিরীক্ষা কাজের ব্যাপারে তদন্ত করতে অনুরোধ করা হয়েছে, তারা সম্মিলিতভাবে ১৭ হাজার ৪১টি নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদান করেছেন, যার অধিকাংশই কোনোরকম নিরীক্ষা না করেই সংস্থাসমূহের তৈরি আর্থিক বিবরণীকে সত্য ও গ্রহণযোগ্য বলে প্রত্যয়ন করা হয়েছে। চলতি বছরের আগস্টের ৩১ তারিখ পর্যন্ত ডিভিএসে রক্ষিত মোট ৪১ হাজার ৮২টি নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রায় ৪০০ নিরীক্ষক দ্বারা সম্পন্ন করা হয়েছে।
অথচ মাত্র ৫০ জন নিরীক্ষক ১৭ হাজার ৪১টি নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদান করেছেন। কিন্তু নিরীক্ষা কাজের গুণগত মান অক্ষুণ্ন রেখে কোনোভাবেই তা করা সম্ভব নয়। সার্টিফিটেক অব প্র্যাকটিসধারী (সিওপি) নিরীক্ষকদের এ ধরনের নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদান করার কারণে সরকারের রাজস্ব আহরণ, ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনা, শেয়ারবাজারের ওপর বিরূপ প্রভাবসহ পেশাদার অ্যাকাউন্ট্যান্টসদের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে।
সূত্র আরও জানায়, তদন্তের আওতায় থাকা ৫০ জন নিরীক্ষক সর্বমোট ৯ হাজার ২৩টি নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদান করেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্বের কারণে আরও প্রায় সাত হাজার ৮২০টি একই ধরনের নিরীক্ষা প্রতিবেদন করার সুযোগ পেয়েছেন।
এখনো তাদের অনেকেই কোনো ধরনের নিরীক্ষা কাজ না করেই নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদান অব্যাহত রেখেছেন। অভিযুক্ত ৫০ নিরীক্ষক প্রায় ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদান করেছেন; বাকি ৩৫০ নিরীক্ষক ৫৮ দশমিক ৫২ শতাংশ নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদান করেছেন— যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এদিকে এ প্রসঙ্গে আইসিএবির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন, এফসিএ জানান, অডিট রিপোর্ট, অ্যাকাউন্টসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া মিলেই একটি রাষ্ট্রের রাজস্ব। এ খাতে শৃঙ্খলা এলে রাজস্ব আদায়ে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। যারা একটু উল্টাপাল্টা বিশেষ করে অ্যাকাউন্টিং অডিটিং স্ট্যান্ডার্ড ফলো করে অডিট করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে নিয়ম মেনে কাউন্সিল শাস্তি দেয়। তবে ওই প্রক্রিয়াটা লম্বা। কাউকে যাচ্ছেতাইভাবে শাস্তি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। নিয়ম মেনেই পদক্ষেপ নেয়া হয় এবং নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়।