ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলো কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেশি তৎপর। গত দুই মাসে জনতা ও রূপালী ব্যাংকের দায়ের করা বিভিন্ন মামলায় বড় বড় ঋণখেলাপি কয়েকজন গ্রাহককে আটক করা হয়েছে। পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে অনেক মামলাও হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রাখা হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় দেশে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম এবং বিচারক সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। ওসব কারণে অর্থঋণ আদালতে মামলাজট তৈরি হচ্ছে।
যদিও ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় দেয়া হয়েছে। ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করলেও এখন খেলাপি করা হচ্ছে না। কিস্তি পরিশোধও অনেক শিথিল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঋণ শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করছে না। কিন্তু এত ছাড়ের মধ্যেও গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে বারবার তাগিদ দেয়ার পরও কিস্তি পরিশোধ করা হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের ব্যাংকিং খাতে গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকা। গত জুনে তা বেড়ে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি দাঁড়িয়েছে। ওই ছয় মাসে ২২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আর গত মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
কিন্তু মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত আরো ১১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা বেড়েছে। ওই ছয় মাসে বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় গত জুনে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। তার আগেও একবার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ছিল খেলাপি ঋণ। কিন্তু কখনোই সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়নি। এবারই প্রথম খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি ছাড়াল।
সূত্র জানায়, চলতি ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। তার মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। দেশে এ যাবতকালের এটিই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের অঙ্ক। সাধারণত যেসব খেলাপি ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা কম থাকে সেগুলো আদায়ের জন্যই ব্যাংকগুলো আদালতে মামলা করে থাকে। সেগুলো হচ্ছে অর্থঋণ মামলা, সার্টিফিকেট মামলা এবং দেউলিয়া ও অন্যান্য মামলা। দেশে সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, এক লাখ ৫২ হাজার ৬২৬টি।
তবে ওই সার্টিফিকেট মামলায় জড়িত টাকার পরিমাণ সবচেয়ে কম, দুই হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬০ হাজার ৯৭৩টি। ওসব মামলার বিপরীতে জড়িত রয়েছে এক লাখ ২৯ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। রিট মামলা আছে পাঁচ হাজার, সেগুলোতে জড়িত টাকার পরিমাণ ৩৪ হাজার ৭৮৮ কোটি। তা ছাড়া দেউলিয়া ও অন্যান্য মামলা রয়েছে ৫৮ হাজার ৪৯৫টি এবং ওসব মামলার বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৮৪ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। আর বছরের পর বছর আটকে থাকছে অর্থঋণ আদালতের মামলা। বিচারকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় ওসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের অর্থঋণ ও সার্টিফিকেট মামলায় বড় বড় ঋণখেলাপি গ্রাহক গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সুদ মওকুফের ঘটনা বেশি ঘটছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন-ওই তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করা ঋণের দুই হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে। যা আগের প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ছিল মাত্র ১৯১ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলো আগের প্রান্তিকের তুলনায় দুই হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা বেশি সুদ মওকুফ করেছে, যা প্রায় ১২ গুণ বেশি। আর ব্যাংকের পরিচালকরাই সুদ মওকুফের বেশির ভাগ সুবিধা নিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকদের সাথে মিলেমিশে যোগসাজশের মাধ্যমেও সুদ মওকুফ করছে।
এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, সবসময় বড় ঋণখেলাপিরা বেশি সুদ মওকুফ-সুবিধা পাচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহকরা ওই সুবিধা থেকে অনেক দূরে থাকে। ওই প্রক্রিয়ার একটি বড় কুফল হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির পরিমাণ বাড়ে। ব্যাংকের পরিচালক, পরিবারের সদস্য বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনের যে বাধ্যবাধকতা দেয়া ছিল গত মে মাসে তা তুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ওই শর্ত শিথিলের পরই ব্যাংক ও পরিচালকরা কৌশলে নিজেদের ঋণের সুদ মওকুফ করে নিচ্ছে। মূলত দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা অনাদায়ী ঋণের আসল টাকা আদায় করতে গিয়ে সুদ মওকুফের কৌশল নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
তবে কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সাথে মিলে যোগসাজশের মাধ্যমেও সুদ মওকুফ করছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে জনতা ব্যাংক লিমিটেডের এমডি ও সিইও মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ জানান, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়ে জনতা ব্যাংক আন্তরিক। সে জন্য যেসব খেলাপি গ্রাহক দীর্ঘসময় ধরে ঋণ পরিশোধে সময়ক্ষেপণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।
একই প্রসঙ্গে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানান, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে রূপালী ব্যাংক কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না।