সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন একাডেমির আয়োজনে আজ ১৭ অক্টোবর থেকে কুষ্টিয়ায় শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী বাউল সম্রাট লালন সাঁইয়ের ১৩২তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে স্মরণোৎসব।
১৮৯০ সালের এই দিনে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে বাউল সম্রাট লালন সাঁই দেহ ত্যাগ করেন। করোনার কারণে পরপর দুই বছর লালন স্মরোণৎসব বন্ধ ঘোষণা করেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম। তবে মনের টানে আখড়া বাড়িতে আসা সাধু ভক্তরা সাধুসঙ্গ বসান লালন মাজারের আশপাশ এলাকার বাড়িতে।
এবার ফকির লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবস উপলক্ষে কালিগাং নদীর পারে বিশাল মঞ্চে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি মোহাম্মদ সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন কুষ্টিয়া-৩ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ।
বিশেষ অতিথি থাকবেন জাতীয় সংসদ সদস্য কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ, জাতীয় সংসদ সদস্য কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রশাসক হাজী রবিউল ইসলাম, কুষ্টিয়া জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আজগর আলী, কুমারখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ আব্দুল মান্নান খান, কুমারখালী পৌরসভার মেয়র মো. সামছুজ্জামান অরুন, কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিতান কুমার মণ্ডলসহ অনেকে। আলোচনা সভা শেষে রাত সাড়ে ৮টায় শুরু হবে লালন একাডেমির পরিবেশনায় লালন সঙ্গীত চলবে মধ্য রাত পর্যন্ত।
অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পুলিশ ও র্যাবকে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুষ্টিয়া লালন একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বর্তমান অ্যাডহক কমিটির জ্যৈষ্ঠ সদস্য মো. তাইজাল আলী খান। ইতোমধ্যে মাজার প্রাঙ্গণে ভক্ত-অনুসারীরা লালন আখড়ায় উপস্থিত হয়েছে। দেশ বিদেশ থেকে আসা লালন ভক্তদের আনাগোনায় লালন চত্বর কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এখনো ভক্তদের আসা থেমে নেই সন্ধ্যা পর্যন্ত আসা চলবে। লালন উৎসবকে ঘিরে শহরের আবাসিক হোটেল ও আশপাশের বাড়িগুলো লালন ভক্তদের আগমনে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।
কুষ্টিয়া লালন একাডেমির সদস্য লালন শিল্পী নাদিম শাহ বলেন, লালন সাঁইয়ের বার্ষিক স্মরণোৎসব উপলক্ষে তার সাধন-ভজনের তীর্থস্থান ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণ এবার পরিণত হয়েছে উৎসবের আমেজ। দেশ-বিদেশ থেকে লালনভক্ত, বাউল অনুসারী ও সুধীজনসহ অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটছে এখানে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম বলেন, লালন স্মরণোৎসব ও গ্রামীণ মেলাকে কেন্দ্র করে মাজার প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুরো মাজার এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় রয়েছে। জেলা পুলিশ, র্যাাব ও গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। সেই সাথে আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে, মানুষ গুরুর দীক্ষা দিতেই সেদিন মানবতার পথ প্রদর্শক হিসেবে মরমী সাধক লালন শাহের আবির্ভাব ঘটে ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজো অজানায় রয়ে গেছে তার জন্মরহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি।
তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। যৌবনকালে পুণ্য লাভের জন্য তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপামত্মার ও সাধন জীবনে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে মলম শাহের আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি সাধক গুরুর আসনে অধিষ্টিত হন। প্রথমে তিনি কুমারখালির ছেঁউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের একটি আমগাছের নিচে সাধনায় নিযুক্ত হন। পরে স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের সাহায্য লাভ করেন।
লালনভক্ত মলম শাহ আখড়া তৈরির জন্য ষোল বিঘা জমি দান করেন। দানকৃত ওই জমিতে ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে ওঠে। প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরি করা হয়। সেই ঘরেই তার সাধন-ভজন বসত। ছেঁউড়িয়ার আখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিষ্যভক্তদের নিয়ে পর্যন্ত থাকতেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক দেহত্যাগ করেন এবং তার সাধন-ভজনের ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়।