চলতি মাসে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা থাকলেও সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও ডলার সংকটের কথা বলে গত ১৮ জুলাই দেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ঘোষণা করেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। রেশনিং পদ্ধতিতে এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে কবলে পড়ে পুরো দেশ। এক সপ্তাহ পরীক্ষামূলক লোডশেডিং ঘোষণা করা হলেও ইতোমধ্যে তিন মাস অতিক্রম করেছে। সংকট সমাধানের পরিবর্তে উল্টো বেড়েছে লোডশেডিং। অস্থির হয়ে পড়েছে নগর জীবন।
প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখব। এতে বিদ্যুতের কিছুটা ঘাটতি হবে। সেই ঘাটতি এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট হবে। সেই ঘাটতি রেশনিং করে মেটানো হবে। ডিজেল সাশ্রয়ে এসি ব্যবহার সীমিতকরণ, আলোকসজ্জায় নিরুৎসাহ প্রদান, পেট্রোল পাম্প সপ্তাহে এক দিন বন্ধ, সরকারি-বেসরকারি দাপ্তরিক সময় কমানোসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার।
এ সময় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী তার ফেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বিদ্যুতের এই দুর্যোগে সময়িক অসুবিধার জন্য সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সবার সহযোগিতার কামনা করেছেন। পরীক্ষামূলক এক সপ্তাহের লোডশেডিংয়ের ঘোষণা থাকলেও তিন মাসেও এর কোনো সুরাহ করতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। যতই দিন যাচ্ছে সারা দেশে লোডশেডিং বেড়েই চলছে।
বাড়ছে লোডশেডিং। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চলছে তীব্র গরম। এর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ে জনজীবন হাঁসফাঁস। আগে এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের সিডিউল থাকলেও এখন পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে।
সিডিউল দেয়া থাকলেও কোনো স্তরে মানা হচ্ছে না লোডশেডিং। এখন রাজধানীতে গড়ে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লোডশেডিং থাকছে। অনেক এলাকায় গভীর রাতেও লোডশেডিংয়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। রাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরে তীব্র গরমে ঘুমাতে পারছে না এসব এলাকার মানুষ। এতে চরম অস্বস্থিতে দিন ও রাত পার করছেন রাজধানীর মানুষ। রাজধানী ছাড়াও বিভিন্ন জেলা শহরেও লোডশেডিং বেড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও শোচনীয় বলে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনা কোনোকালেই টেকসই ছিল না। সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের পর বিদ্যুৎ খাতে সরকারের দ্বিতীয় শীর্ষ উন্নয়ন ব্যয়ের খাত হলেও এই খাতকে টেকসই করা যায়নি; বরং কিছু অতি ধনী ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি করেছে। চুক্তির ফাঁকে ও ফাঁদে আটক দেখিয়ে আদতে কতিপয় লোকই কৌশলে সরকারের বাজেট-সংকট তৈরি করেছে।
সব মিলিয়ে যা দেখা যায়, তার চেয়েও বাস্তব সংকটের গভীরতা বেশি। এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই রাজধানীতে শিডিউল করে দেয়া হচ্ছিল লোডশেডিং। সেই ঘোষণার প্রথম প্রথম কিছু দিন রাজধানীতে দিনে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেয়া হয়। কিন্তু দিন যত যায় তত বেশি লোডশেডিংয়ের সময় বাড়তে থাকে। এ ছাড়াও চলতি মাসে সব থেকে বেশি লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে রাজধানীবাসী।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ কখন যায় আর আসে ঠিক নেই। দুই-তিন ঘণ্টা পরপর কারেন্ট যাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাত থেকে আট ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকছে না। রাহেলা খাতুন নামের এক গৃহিণী আমার সংবাদকে জানান, দিনে তো বিদ্যুৎ যাচ্ছেই, আবার রাতেও যাচ্ছে। রাতে বিদ্যুৎ যাওয়ার কারণে ঘুম হচ্ছে না। বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে না। অনেক ভোগান্তি হচ্ছে। জানি না এভাবে আর কতদিন চলবে।
ঢাকার বাইরে এ সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। আগে তাও ২৪ ঘণ্টা লোডশেডিং তিন চার ঘণ্টা লোডশেডিং স্বাভাবিক হিসেবেই নিয়েছিল গ্রাম-গঞ্জের মানুষ। কিন্তু এখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮-১২ থাকছে না বিদ্যুৎ। এতে নাজেহাল হতে হচ্ছে এসব এলাকার মানুষদেরকে। লোডশেডিং নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে লোডশেডিং থাকবে না বলে জানিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। অক্টোবর থেকে পুরোপুরি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের কথা বলেছিল তারা। কিন্তু চিত্র পুরোটাই বিপরীত।
ডিপিডিসি সূত্র জানিয়েছে, তাদের চাহিদা এক হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ পাচ্ছে এক হাজার ১৫০ মেগাওয়াট। ফলে দিনে-রাতে ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। উৎপাদন কম হওয়ায় সরবরাহ ঘাটতি। তাই লোডশেডিং করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন গড়ে ৯৫০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করছে পেট্রোবাংলা। গ্যাস দিয়ে ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা থাকলেও পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
পেট্রোবাংলা সূত্র থেকে জানা যায়, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এতদিন কাতার থেকে গড়ে প্রতি মাসে পাঁচটি করে এলএনজির কার্গো আসত। কিন্তু চলতি অক্টোবর ও আগামী নভেম্বরে আসবে চারটি করে। ফলে জাতীয় গ্রিডে ১০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ কমে যাবে। গ্যাস সাশ্রয়ের জন্য আরও দুই ঘণ্টা সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে গত কয়েক মাস ধরে দেশে চলা ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে আরও হতাশার কথা শুনিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এর আগে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে জানালেও এবার তিনি বলছেন, নভেম্বরের আগে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি উন্নতির কোনো আশা তিনি দেখছেন না। এদিকে হতাশার কথা হলো নভেম্বরের আগে গ্যাস আনতে না পারায় লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতির আশা নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসলে যা ভাবা হচ্ছে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ। এরপরও সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে লোকসান করছে, কখনো কখনো দিনেই ১০০ কোটির বেশি লোকসান। আন্তর্জাতিক অপরিশোধিত তেলের বাজারের বিগত কয়েক মাসের মূল্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে প্রতি ব্যারেলে মূল্য ৬৮ ডলার থেকে ১২০ ডলারে ওঠানামা করেছে। গড় হিসাবে মূল্য আনুমানিক ৮৪ ডলার ছিল, গত নভেম্বর থেকে এক বছরে গড়ে মূল্য বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ১২-১৫ শতাংশ। ইউক্রেনে হামলার মুহূর্তে অল্প সময়ের জন্য ১২০ ডলারে উঠে আবার কমেও এসেছে। বিপরীতে বাংলাদেশে ডিজেলের দাম নভেম্বরে ২৩ শতাংশ এবং আগস্টে সাড়ে ৪২ শতাংশ; এক বছরের কম সময়, অর্থাৎ মাত্র ৯ মাসে সাড়ে ৬৫ শতাংশ বেড়েছে।
অথচ এই বছরে তেলের দাম একবার ব্যারেলে ৬৫ ডলার এবং আরেকবার ৮০ ডলারে নেমেছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমেনি। এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলে ৮৯ ডলার। কিন্তু ডলার-সংকটে সরকার তেল-গ্যাস কিনতে পারছে না। বিদ্যমান সরবরাহ চুক্তিগুলো ছোট বলে জ্বালানি ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। স্পট মার্কেটের দাম আন্তর্জাতিক বাজারদর থেকে এবং বাড়তি কমিশনের কারণে এখান থেকে কেনায় খরচ অনেক বেশি পড়ে।
অথচ হাতে ডলার নেই, এক বছরে আমদানি ও রপ্তানির ঘাটতি অন্তত ৩৩ বিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, লোডশেডিং করতে গিয়ে দেখা গেল, বিদ্যুৎ গ্রিড স্মার্ট নয়। অটোমেশন না করে সেখানেও চুরি এবং পরিকল্পনাহীন কাজ হয়েছে। শখানেক বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাজার হাজার সাবস্টেশন স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণের স্ক্যাডা সেন্টারে সংযুক্ত নেই, অর্থাৎ অটোমেশনে নেই। পুরোনো সমস্যা ছিল গ্রীষ্মে প্রায় ২০ হাজার ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড ছিল! ফলে দূরনিয়ন্ত্রণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লোড কমানো যায় না; বরং ফোনে নির্দেশ দিয়ে হাতে লোডশেড করতে হয়। এ রকম ‘ম্যানুয়াল’ লোডশেডের সাথে উৎপাদনও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। বেসরকারি বহু কেন্দ্র স্ক্যাডা ও লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারে সংযুক্ত নেই বলে এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ ও সচল করা যায় না। সমস্যা বহুমুখী, এরই মধ্যে জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হয়ে গেছে এক বছরে দুবার।
লোডশেডিংয়ে ভয়াবহতার সম্পর্কে প্রখ্যাত জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, ‘সংকট সমাধানে দেশীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জ্বালানির জোগান দিতে গেলে অর্থ লাগবে। আমরা সেই অর্থসংকটে আছি। সেই সংকটটা নভেম্বরে কেটে যাবে, আর বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, তা আমি যৌক্তিক মনে করি না। লোডশেডিং কমাতে পারলেই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়ে গেল, সেটি মানতেও আমি রাজি নই।
আরেকটি বিষয় হলো, যদি লোড কমে যায়, তাহলে তো বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আগের চেয়ে স্বাভাবিক হবে। চলমান পরিস্থিতি শিগগিরই উন্নত হচ্ছে না। কয়লা, তেল বা গ্যাস ক্ষেত্রে এখনো আমরা আমদানিনির্ভর। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এর জন্য জ্বালানি প্রয়োজন। ফলে জ্বালানি সরবরাহ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে জ্বালানি আমদানি করতে হবে।’