চাল, তেল, লবণ ও পেঁয়াজের পর এবার বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে চিনি। বৈশ্বিক সংকটের অজুহাতে অসাধু চক্র একের পর এক কারসাজির মাধ্যমে বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। সরকারের সংস্থাগুলোর আপ্রাণ চেষ্টাও কোনো কাজে আসছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্পোরেট মাফিয়াদের হাতে জিম্মি সাধারণ মানুষ। তাই অভিযান নাটক বন্ধ করে প্রতযোগিতা কমিশনের মাধ্যমে মামলা ও গ্রেপ্তার করে শাস্তির ব্যবস্থা না করলে নিস্তার দেখছেন না ভোক্তারা।
তাদের দাবি, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা লোকজনের সিন্ডিকেট সংকট তৈরি করায় তাদের দমন করা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত চিনি আমদানি করা হয়েছে। তাই সংকটের কোনো কারণ নেই। যথাযথ তদারকি করলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অপরদিকে ভোক্তা অধিকার বলছে— চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত রিফাইন করা না গেলেও এখনই সংকট হওয়ার কথা নয়। গোডাউনে পর্যাপ্ত চিনি মজুত থাকলেও বাজারে সংকট তৈরি করা হচ্ছে।
এছাড়া আমদানি করা চিনি রিফাইন করে বাজারে আনতে পারলে ঘাটতি থাকবে না। তাই সংস্থাটি ইতোমধ্যে অভিযানের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করে সরবরাহ ঠিক রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণে সক্ষমতার বিপরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিনি রিফাইন করা যাচ্ছে না। তাই সরবরাহ চেইন সচল না থাকায় বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেশে চিনি আমদানির তথ্য জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ এ সংক্রান্ত এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সমপ্রতি দেশের বাজা?রে চি?নির দাম বেড়ে গেছে। সংকটের কার?ণে দাম বেড়েছে এমন কথা বলা হ?চ্ছে। এ তথ্য স?ঠিক নয়।
কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকা তথ্য মতে, ২০২১ সালে দেশে ১৭ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত সাড়ে ১৬ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে। শিগগিরই আরো এক লাখ টন চিনি আমদানি হবে। তাই দেশে পর্যাপ্ত চিনি আমদানি হয়েছে। যদি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বিশেষ তদারকি করে তাহলে চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।’
সরকারি তথ্য মতে, দেশে বছরে মোট চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। চিনি শিল্প কর্পোরেশন ২৪ হাজার টন দেশীয় চিনি উৎপাদন করছে। তাই চাহিদার বেশির ভাগই আমদানি করা হয়। গত কয়েকদিনে হঠাৎ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে চিনির বাজার। সংকটের কথা বলে সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্যের চেয়ে ২০-২৫ টাকা বেশি দামে চিনি বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। অনেক এলাকায় চিনি পাওয়াই যাচ্ছে না। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় এই ভোগ্যপণ্যটি নিয়ে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বেশির ভাগ দোকানে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকা কেজিতে। কোথাও কোথাও ১২০-১২৫ টাকাও দাম হাঁকানো হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছে ৯৫-১০০ টাকায়। তবে দোকানগুলোতে প্যাকেটজাত চিনি পাওয়াই যাচ্ছে না।
দোকানিরা বলছেন, দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহ বন্ধ রেখেছে কোম্পানিগুলো। সরকারের বেঁধে দেয়া দাম মানতে চাইছে না তারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ৬ অক্টোবর খোলা চিনি ৯০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনির দাম ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। উল্টো সরবরাহ ঘাটতির উল্লেখ করে দাম ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মূলত চিনি আমদানি ও বাজারজাত করে সিটি, মেঘনা, এস আলম, ইগলু ও দেশবন্ধু গ্রুপ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থাটি সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ১৪৮ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অভিযোগে ছয় লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানাও করেছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠকে বসে ভোক্তা অধিকার।
গতকাল রোববার কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় সভা শেষে চিনির বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সাইফুজ্জামান বলেন, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ‘র সুগার’ আছে। কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে রিফাইন করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। প্রতিদিন আমাদের পাঁচ হাজার টন চিনির চাহিদা রয়েছে। এটি যদি প্রতিদিন আমরা উৎপাদন করতে পারি রিফাইন করে, তাহলে এই সমস্যা আর থাকবে না।
তিনি বলেন, চিনি মিলগুলোতে মনিটরিং করা হচ্ছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী মেঘনার ফ্রেস মিলের সাপ্লাই চেইন ঠিক আছে। তবে উৎপাদন কমে গেছে। তাদের প্রতিদিন চিনি উৎপাদনে সক্ষমতা প্রায় তিন হাজার টন। কিন্তু সেখানে তারা উৎপাদন করতে পেরেছে মাত্র এক হাজার ৯০০ টন। এটি তাদের উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় অর্ধেক। কারণ হিসেবে গ্যাস সংকটের কথা বলছেন মিলসংশ্লিষ্টরা। একই অবস্থা অন্য মিলগুলোর। বিষয়টি সমাধানে উদ্যোগ নিতে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা মিলগুলোর কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি ডেলিভারি (এসও) পর্যায়ে তারা যেন পণ্যের দাম উল্লেখ করে দেয়। তাতে করে ডিলাররা মিলের অজুহাতে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না। ভোক্তাদের জন্য সরকার নির্ধারিত দামে খোলা চিনি ৯০ টাকা ও প্যাকেজজাত ৯৫ টাকা যেন বিক্রি করা হয়। এর বাইরে কেউ কারসারি করতে চাইলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, অনেক ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানে চিনি থাকার পরও তারা বলছে চিনি নেই। অথচ অনেকের গোডাউনে থরে থরে চিনি সাজানো আছে। আমারা তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবো। কোথায় সমস্যা, কারা সমস্যা সৃষ্টি করছে— এ বিষয়ে আমরা একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছি সোমবার (আজ) এটি সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে। ব্যবসায়ীরা চিনির চাহিদা আমাদের দেবে। আমরা রিফাইন চিনি ট্রাকে করে তাদের কাছে পৌঁছাব। এরপরও যদি কেউ কারসাজি করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।
এ বিষয়ে ভোক্তাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো ব্যর্থ। তাই একের পর এক সংকট তৈরি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ভোক্তা অধিকারসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযানে কোনো ফল আসছে না। প্রতিযোগিতা কমিশনের উচিত সিন্ডিকেটে জড়িতদের চিহ্নিত করে মামলা করা। একই সাথে আগে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে শাস্তির ব্যবস্থা করা।