আজ থেকে চিনি সংকট সমাধানের প্রতিশ্রুতি

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২২, ০১:১২ এএম
আজ থেকে চিনি সংকট সমাধানের প্রতিশ্রুতি

দেশে অপরিশোধিত চিনির কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু গ্যাস না পাওয়ার কারণে চাহিদামতো চিনি পরিশোধন করতে পারেনি মিলগুলো। যে কারণে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। তবে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। রাত থেকেই পরিশোধনকারী মিলগুলো চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক করবে। ফলে মঙ্গলবার থেকেই বাজারে চিনির সংকট কেটে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বেসরকারি চিনি সরবরাহকারী মিলমালিক ও চিনি ব্যবসায়ীরা।

গতকাল সোমবার জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে চিনির সরবরাহ এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে মিলমালিক, রিফাইনারি, পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের মতবিনিময় সভায় তারা এ প্রতিশ্রুতি দেন। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভার শুরুতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে র-সুগারের (অপরিশোধিত চিনি) কোনো ঘাটতি নেই। যে পরিমান চিনি মজুত রয়েছে, তাতে তিন থেকে চার মাস চাহিদা পূরণ সম্ভব। কমিশনের উপ-পরিচালক মাহমুদুল হাসান প্রতিবেদনে বলেন, সরকারি নির্দেশনায় ২৩ অক্টোবর তথ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সেখানে আমরা দেখেছি, দেশে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন।

এর মধ্যে এখন সরকারি মিলে আখ থেকে উৎপাদন হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টন। বাকিটা আমদানি করা র-সুগার থেকে পরিশোধ করে বেসরকারি কোম্পানিগুলো সরবরাহ করে। অর্থাৎ চিনির বাজার ৯৫ শতাংশের বেশি তাদের নিয়ন্ত্রণে। এ প্রতিবেদনের জন্য গতকাল পর্যন্ত বেসরকারি চিনি কারখানাগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিটি গ্রুপের মিলে এখন পর্যন্ত অপরিশোধিত ৩৮ হাজার টন চিনি মজুত রয়েছে।

এ ছাড়া পাইপলাইনে আছে আরও ৬১ হাজার টন। মেঘনা গ্রুপে ২৩ হাজার টন অপরিশোধিত মজুত ও পাইপলাইনে আছে ৫৫ হাজার টন। একইভাবে এসআলম গ্রুপের কাছে ৬৬ হাজার টন মজুত এবং এক লাখ ১০ হাজার টন পাইপলাইনে। আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারির কাছে মজুত আছে ২২ হাজার টন, আর পাইপলাইনে রয়েছে ৫০ হাজার টন এবং দেশবন্ধুর কাছে চার হাজার টন মজুত এবং ৫৫ হাজার টন পাইপলাইনে রয়েছে।

অর্থাৎ দেশে এখন এক লাখ ৫৪ হাজার টন অপরিশোধিত চিনির মজুত রয়েছে। এ ছাড়া দুই লাখ ২১ হাজার টনের মতো আমদানির চিনি পাইপলাইনে রয়েছে। অর্থাৎ মজুত চিনি দিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ দিন চাহিদা পূরণ সম্ভব। আর পাইপলাইনের চিনি হিসাবে নিলে তিন মাসের বেশি সময় খাওয়া যাবে। এ সময় ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, এমন পরিস্থিতির পরও চিনি নিয়ে মহাসংকট হয়েছে। এর আগে ভোজ্যতেল নিয়েও এমন করা হয়েছিল।

পরে সেখানে কারসাজি ছিল সেটার প্রমাণ পেয়েছি। চিনির ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা হতে পারে। সেটি দেখছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ৯০ টাকার চিনি রাতারাতি ২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হবে।

তিনি বলেন, আমরা গত তিন দিন বাজারে অভিযান পরিচালনা করেছি। খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের সাথে বৈঠক করেছি। খচুরা বিক্রেতারা বলছেন, তারা চিনি পাচ্ছেন না। কিন্তু আদতে তারা ঠিকই বেশি দামে বিক্রি করছেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরাও বলছেন মিলগুলো তাদের চিনি দেয় না। কিন্তু তারা যে চিনি বিক্রি করছে তাতে তাদের কোনো ভাউচার নেই। তাহলে নিশ্চয়ই অনৈতিকভাবে বেশি দামে কেনাবেচা হচ্ছে।

সফিউজ্জামান বলেন, দেশে প্রতিদিন চিনির চাহিদা পাঁচ হাজার টন। বড় একটি গ্রুপ একাই প্রতিদিন এ পরিমান চিনি পরিশোধন করতে পারে। এমন পাঁচটি কোম্পানি রয়েছে চিনির বাজারে। তারপরও তারা কেন পারছেন না? চিনির সংকট কেন হলো? সফিউজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সকালে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যেকোনো মূল্যে উৎপাদন ঠিক করতে হবে। এ জন্য যা যা দরকার সেটি আমরা করব। সাপ্লাই চেইনের ঘাটতি ঠিক করে ফেলব। এসময় রিফাইনারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এবং দেশবন্ধু সুগার রিফাইনার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, আমরা একে আপরের সাথে ব্লেম গেইম খেলছি। আমার যদি এটিকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে সবাইকে দায়ভার নেয়া উচিত।

তিনি বলেন, এ নিয়ে এ পর্যন্ত আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলে কথা বলেছি। ফলে আমাদের যেগুলো সমস্যা ছিল— সেটি এখন সমাধান হচ্ছে। রাত থেকে মিলগুলোর সাপ্লাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তারপর যদি কেউ চিনি না পান তবে আমাদের বলবেন, আমরা ব্যবস্থা করে দেবো। যেখানে চিনি নেই বলবেন, সরকার নির্ধারিত দামে দিয়ে দেবো। সমস্যা আর হবে না। গোলাম রহমান বলেন, আমাদের গ্যাসের সমস্যা আছে, র-সুগারের দাম এই মুহূর্তে ৫০০ ডলারের ওপরে। আমাদের ডিউটি বেশি, এক কেজিতে ৩১-৩২ টাকা দিতে হয়। এখন ডলারের দাম বেশি, ৮৫ টাকার ডলার কিনছি ১০৫ টাকায়। অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুও বেড়েছে।

সেগুলোর দিকে সরকার দৃষ্টি দেবে, সেটি আমাদের জানিয়েছে। সেগুলো সমাধান হলে ভবিষ্যতেও আর সমস্যা হবে না।
এস আলম গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, কিছু মিলে সমস্যা হলেও আমাদের তরফ থেকে কিন্তু এতদিন শতভাগে সরবরাহ দিয়েছি। আমরা লাকি যে, চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহে তেমন সমস্যা হয়নি। সে জন্য আমরা কোনোভাবে সরকার নির্ধারিত দামের বেশি বিক্রি করছি না। সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আমরা চাই সবাই পর্যাপ্ত পণ্য পাক। সমস্যা হয়েছে, সেটি এখন কথা বলে সমাধান হচ্ছে। ডিইটি কমানো হলে সেটি আরও ভালো হবে। কারণ প্রতিটি ক্রেতাকে ৩২ টাকা চিনিতে ডিউটি দিতে হচ্ছে। এটি চিনির দাম অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, সব থাকার পরও চিনি নেই। সেটা গ্যাসের সমস্যার কারণে। চিনি পরিশোধনে স্ট্রিম করতে গেলে গ্যাসের চাপ পাচ্ছি না। সিটির দিনে উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ হাজার টন। কিন্তু চিনি হচ্ছে ১৩০০-১৪০০ টন। মেঘনাসহ সবার এ অবস্থা। এখন গ্যাসের সমস্যা সমাধান হলে বাজারে চিনির অভাব হবে না।

এসব বিষয়ে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না তা নয়। আপনাদের যে গ্যাসের চাপ প্রয়োজন সেটা সবসময় নেই। আমারা এ নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আর গ্যাস নিয়ে সমস্যা হবে না। আলাদা করেই সরকারের গ্যাস সরবরাহকারীদের সাথে কথা বলব।

তিনি বলেন, আমরা চিনির সমস্যা সমাধানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট দেবো। শুল্ক কমালে সেটা প্রভাব বাজারে পড়বে কি-না সেটা দেখতে হবে। এরপরও শুল্কের কথা আমরা এনবিআরকে বলব। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছি, মিলগেটে চিনির ট্রাক আটকানো হচ্ছে, বসে থাকছে। সেটি ঠিক করতে হবে। সেটি খরচ বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া পাকা রশিদে আপনাদের লেনদেন ঠিক করতে হবে। রশিদ ছাড়া কোনো লেনদেন হবে না। মিলগুলোকের এসওতে চিনির ইউনিট প্রাইস লেখতে হবে। ডিও ব্যবস্থা সংশোধন করতে হবে। ডিরেক্ট ডিলারের মাধ্যমে চিনি দিন। তিনি বলেন, মিলমালিকরা এখন প্রতিদিন আমাদের উৎপাদন ও সরবরাহের তথ্য দেবেন। এ সময় পেট্রোবাংলার প্রতিনিধি বলেন, খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের গ্যাসের চাহিদা পূরণে আলাদা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কাল-পরশুর মধ্যে সেটা ঠিক হয়ে যাবে।

চিনি নিয়ে অনিয়ম : ২৭৮ প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ টাকা জরিমানা
চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতির কথা বলে হঠাৎ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে দেশের চিনির বাজার। সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্যের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে, আবার কোনো কোনো এলাকায় চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে চিনি নিয়ে কারসাজি ও কৃত্রিম সংকটকারীদের ধরতে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযানে নামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় বেশি দামে চিনি বিক্রি, মজুতের অপরাধে ২৭৮ প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল সোমবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গত ২২ ও ২৩ অক্টোবর সারা দেশে চিনির বাজারে ১০৩টি তদারকি ও অভিযান করে এ জরিমানা করা হয়।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংকটের কথা বলে সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে খোলা চিনির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনি অনেক এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রেতারা বলছেন, জনগণকে জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা খেলায় মেতেছেন। তারা সরকারের কোনো নিয়ম-নীতি মানছেন না। নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন। আর ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে চিনির উৎপাদন কমেছে। যে কারণে বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বেশির ভাগ দোকানে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা কেজিতে। এক সপ্তাহ কিংবা তিনদিন আগের কেনা চিনি কিছু কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা কেজিতে। বাজার ও দোকানগুলোতে প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এই দোকানগুলোতে এক সপ্তাহ আগেও চিনি বিক্রি হয়েছে ৯০-৯৫ টাকা কেজিতে। আর প্যাকেটজাত চিনি ছিল ৯৫ টাকা কেজি।

গত ৬ অক্টোবর সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খোলা চিনি ৯০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। বরং এখন উল্টো দাম বাড়ছে। বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। যার বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে ১৭ লাখ মেট্রিক টন চিনি আমদানি করা হয়েছিল। চলতি ২০২২ সালে ইতোমধ্যে সাড়ে ১৬ লাখ মেট্রিক টন চিনি আমদানি সম্পূর্ণ হয়েছে। গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত বছরের তুলনায় এ বছর চিনি সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। শিগগিরই আরও এক লাখ টন চিনি আমদানি করা হচ্ছে। একটু তদারকি করলে চিনির বাজার স্বাভাবিক হবে।