ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঝড়ো হওয়া ও ভারী বৃষ্টি হয়েছে। ঝড়ো হওয়া ও বৃষ্টিতে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দেশের ১৬ জেলায় অন্তত ৩৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে গাছচাপা, দেয়ালচাপা ও নৌকাডুবিতে তাদের মৃত্যু হয়।আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গত সোমবার রাতে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজারডুবির ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া শ্রমিকদের সবার বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠী এলাকায়।
ভোলা : ভোলায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ভোলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, (সোমবার) রাতে ঘূর্ণিঝড়ের দমকা হাওয়ায় গাছের চাপায় প্রাণ যায় বিবি খাদিজা (৬৮) নামে এক নারীর। চরফ্যাসন উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় মোটরসাইকেলে করে দুজন যাওয়ার পথে গাছের ডাল পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান সোনা ব্যবসায়ী মো. মাইনুদ্দিন (৪৫)। ভোলা সদর উপজেলার চেউয়াখালী গ্রামের মফিজুল ইসলাম (৭০) ঘরচাপায় এবং লালমোহন উপজেলার ফাতেমাবাদ গ্রামের ফরিদুল ইসলামের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (২৫) পানিতে ডুবে মারা যান।
বরগুনা : বরগুনা সদর উপজেলার সোনাখালী এলাকায় একটি ঘরের চালে গাছ পড়লে ওই ঘরে থাকা আমেনা খাতুন নামে এক নারী মারা যান। সোনাখালী এলাকার সমাজকর্মী এনামুল হক ওরফে শাহীন জানান, ঘূর্ণিঝড়ে নিহত আমেনা খাতুনের বয়স ১০০ বছরের বেশি। ওই নারী রাত ৮টার দিকে ঘরের ভেতর খাবার খাচ্ছিলেন। ঝড়ের সময় একটি গাছ তার ঘরের ওপর পড়ে। এ সময় চাপা পড়ে তিনি মারা যান।
পটুয়াখালী : পটুয়াখালী সদর উপজেলার প্রতাপপুর খেয়াঘাট এলাকায় লোহালিয়া নদীতে ইটবোঝাই ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন ট্রলারের শ্রমিক নুরুল ইসলাম (৪৫)। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পটুয়াখালী নদী ফায়ার স্টেশনের ডুবুরিরা তার লাশ উদ্ধার করেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ট্রলারটি নোঙর করতে গেলে সেটি ডুবে যায়। ফায়ার স্টেশনের লিডার মজিবুর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কক্সবাজার : কক্সবাজারের টেকনাফে দুজনের মৃৃত্যু হয়েছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়লে ডেক থেকে পড়ে শৌমিং (৭১) নামের একজনের মৃৃত্যু হয়। তিনি মিয়ানমারে নাগরিক। তিনি ওই জাহাজের বাবুর্চি ছিলেন। এ ছাড়া ঝড়ের সময় নিখোঁজ এক শিশুর লাশ পরে টেকনাফ পৌরসভার একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। সোহেনা (৯) নামের শিশুটি টেকনাফ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা জাফর আলমের মেয়ে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান দুজনের মৃৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেন।
নোয়াখালী : ঝড়ের সময় রান্নাঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা গ্রামে এক শিশুর মৃৃত্যু হয়েছে। সানজিদ আফ্রিদি নামের শিশুটির বয়স ১১ মাস। সানজিদ ওই গ্রামের বাসিন্দা আইনজীবী মো. আবদুল্লাহর ছেলে। নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া : জেলার কসবা উপজেলার ধজনগর গ্রামে গাছের নিচে চাপাপড়ে জয়নাল আবেদীন (২৫) নামে এক তরুণের মৃৃত্যু হয়েছে। একই ঘটনায় আহত জয়নালের স্ত্রী নিপা আক্তার (২০) কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।
ঝালকাঠি : ঝালকাঠির নলছিটিতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ের কবলে পড়ে বাবুল সিকদার (৪৫) নামে এক কৃষকের মৃৃত্যু হয়েছে। বাড়ি থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে তিনি পানিতে পড়ে যান। পরে রাস্তার পাশের খাল থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুশঙ্গল ইউপির সচিব মো. জাহিদুল আলম।
টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের দুই কনস্টেবল ও এক আসামি নিহত হয়েছেন। মধুপুর থানার ওসি মাজহারুল আমীন জানান, জামালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ সদস্যরা দুই আসামির ডিএনএ পরীক্ষার জন্য একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। পথে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যে মাইক্রোবাসটি রাত সাড়ে ৮টার দিকে গোলাবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এতে দুই পুলিশ সদস্য কনস্টেবল নুরুল ইসলাম ও মো. সোহেল ও আসামি লালন নিহত হন। এদিকে ঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকে তলিয়ে যাওয়া আইপিএস সরাতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্টে মারা যান টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়া পাঞ্জাপাড়া এলাকার শরীফ ফকির। সদর থানার ওসি মোহাম্মদ আবু ছালাম মিয়া এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ তাদের কাছে দেয়া হয়েছে।
কুমিল্লা : কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা হেসাখাল গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় সোমবার রাতে ঘরের ওপর গাছ পড়লে এক পরিবারের তিন জন নিহত হয়েছেন। নাঙ্গলকোট থানার ওসি ফারুক হোসেন জানান, নিহত তিন জন হলেন নিজাম উদ্দিন, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার ও তাদের চার বছরের মেয়ে নুসরাত আক্তার।
নড়াইল : নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে সোমবার রাতে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মারা যান মর্জিনা বেগম (৪০) নামে এক নারী। তার বাড়ি বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জনবাহার গ্রামে।
সিরাজগঞ্জ : প্রবল ঢেউয়ে সিরাজগঞ্জে নৌকাডুবিতে মা ও ছেলের মৃৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত ৯টার দিকে জেলা সদরের সয়দা ইউনিয়নের মোহনপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত দুজন হলেন মোহনপুর গ্রামের খোকন হোসেনের স্ত্রী ও শিশুসন্তান। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম জানা যায়নি।
গোপালগঞ্জ : গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গাছচাপায় দুই নারীর মৃৃত্যু হয়েছে। টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি মুহাম্মদ আবুল মনসুর জানান, এই দুই নারী হলেন উপজেলার পাঁচকাহনিয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) ও বাঁশবাড়ির চরপাড়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রোমেছা বেগম (৫৮)।
শরীয়তপুর : শরীয়তপুরে গাছের নিচে চাপাপড়ে সাফিয়া বেগম (৬৫) নামের এক নারীর মৃৃত্যু হয়েছে। তিনি জেলার জাজিরা উপজেলার সিডারচর এলাকার হালান মুসল্লির স্ত্রী। জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, সাফিয়ার পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে মৃৃত্যুটা এড়ানো যেত।
মুন্সিগঞ্জ : মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবের সময় বসতঘরে গাছ ভেঙে পড়লে মা ও মেয়ের মৃৃত্যু হয়। লৌহজং থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল তায়েবী জানান, নিহত দুজন হলেন উপজেলার কনকসার এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী আসমা বেগম (২৮) ও তার মেয়ে সুরাইয়া আক্তার (৩)।
গাজীপুর : গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ইকুরিয়া গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় ঘরচাপায় আনিসুর রহমান (৯) নামে এক শিশুর মৃৃত্যু হয়েছে। কাপাসিয়ার ইউএনও এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান জানান, ঘূর্ণিঝড়ের সময় মাটির ঘর ধসে গিয়ে পাশের টিনের ঘরকে চাপা দেয়। এতে ওই ঘরে থাকা শিশু আনিসুরের মৃৃত্যু হয়।