স্বাধীনতা-পরবর্তী বিধ্বস্ত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। ২০১৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পরই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। অভিন্ন প্রশ্নপত্রে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা, ঝরেপড়া রোধে উপবৃত্তি প্রদান ও স্কুল ফিডিং কার্যক্রম, শিক্ষকদের আইসিটি-ইন-এডুকেশন প্রশিক্ষণসহ অজস্র উন্নয়নের সাক্ষী তিনি। সমপ্রতি আমার সংবাদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় অগ্রগতি, প্রতিবন্ধকতা ও সামনের পরিকল্পনার নানা অধ্যায় উন্মোচন করেছেন তিনি। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন আমার সংবাদের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক ও আলমগীর হুসাইন
আমার সংবাদ : স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করলেও দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় উন্নতির ছাপ খুব একটা লাগেনি। এর পেছনে কি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে?
মো. জাকির হোসেন : আসলে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর একটি চ্যালেঞ্জ। নানাভাবে আমরা সেই সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করতে পারি। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সংকট, অন্যদিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দুটোই ছিল। এমন সংকটের মধ্যেও খাদ্য-বস্ত্রের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষায়ও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। তবে দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ খাতকে আরও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ছিল। স্বাধীনতা-পূর্বকালে ঔপনিবেশিক আমলে দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় যে অবস্থান ছিল, সেখান থেকে আজ ২০২২ সালে এসে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এ কথাটি মনে রাখা জরুরি, যেকোনো উন্নয়নের শর্ত হচ্ছে মানবিক উন্নয়ন। মানবিক উন্নয়নের ভিত্তি হচ্ছে শিক্ষার উন্নয়ন। নানামুখী প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্ব্বেও আমরা সেই ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে কাজ করে যাচ্ছি।
আমার সংবাদ : গবেষণায় দেখা গেছে করোনা-পরবর্তী প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এসব শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?
মো. জাকির হোসেন : করোনা-পরবর্তী সময়ে খুব বেশি শিক্ষার্থী যে ঝরে পড়েছে তা কিন্তু নয়। তবে করোনা মহামারির প্রভাবে শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের মতো ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে করোনাকালীন সময়ে শিক্ষকদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সাথে শিক্ষকরাও অনলাইনে-অফলাইনে শিক্ষার্থীদের সাথে সংযুক্ত থেকেছেন। ক্ষেত্র বিশেষ বাল্যবিয়ে বন্ধে শিক্ষকরাও কাউন্সেলিং করেছেন। অপরদিকে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে মিড মিল চালু করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় শিশুরা একবেলা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের অনেকেই স্কুলে নিয়মিত হচ্ছে। এ ছাড়া করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ করতে সব শিশুকে নিয়ে ‘এডুকেশন রিকভারি প্ল্যান’ নিয়ে কাজ চলছে।
আমার সংবাদ : বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনগুলোতে অতিরক্ত বইয়ের চাপ উদ্বেগের কারণ হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি-না?
মো. জাকির হোসেন : কিন্ডারগার্টেনগুলোতে এনসিটিবির নির্দেশনা না মেনে শিশুদের অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। একই সাথে এসব বই বিক্রিতেও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে বলে আমরা জেনেছি। এসব সমস্যা নিরসনে আমরা এনসিটিবির সাথে বিশদ আলোচনা করেছি। প্রতিবন্ধকতা থাকলেও খুব দ্রুত কিন্ডারগার্টেন পরিচালনার স্পষ্ট নীতিমালা, পাঠ্যক্রম, টিউশন ফিসহ নানা বিষয় নিয়ে বিস্তারিত একটি নির্দেশনা দেয়া হবে। একই সাথে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো পড়াশোনার নামে যাতে শিশুদের মানসিক বিষণ্নতার কারণ না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে। কোনো কিন্ডারগার্টেন পরিচালক এ নির্দেশনা না মানলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আমার সংবাদ : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হলে শিক্ষকদের মানোন্নয়ন জরুরি। শিক্ষকদের মান বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি-না?
মো. জাকির হোসেন : আমাদের শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে পিটিআইসমূহে আইসিটি ল্যাব স্থাপন করে শিক্ষকদের আইসিটি-ইন-এডুকেশন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। যাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষালাভ করতে পারে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পিটিআইসমূহে ১৮ মাসব্যাপী ডিপ্লোমা-ইন-প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্স চালু করা হয়েছে। উপজেলা রিসোর্স সেন্টারসমূহে শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিকসহ দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিক্ষকদের প্রয়োজনমাফিক নিড বেজড সাব ক্লাস্টার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জেলা পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের বিদেশে ভ্রমণ ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষকদের বিদেশে মার্স্টাস ডিগ্রি অর্জন করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বাজেটে বরাদ্দ বেশি রাখা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৪ এর মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
আমার সংবাদ : আগামী প্রজন্মের জন্য কেমন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ব্যবস্থা রেখে যেতে চান?
মো. জাকির হোসেন : আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। এমতাবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন অত্যন্ত আবশ্যকীয়। কেননা, প্রাথমিক শিক্ষায় গুণগতমান অর্জন হলে সর্বক্ষেত্রে এর সফল প্রভাব পড়বে। অন্যথায় দেশের অগ্রগতি বাধার সম্মুখীন হতে পারে। সুতরাং আগামী প্রজন্মের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ব্যবস্থা হবে দক্ষতাভিত্তিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর।
আমার সংবাদ : আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মো. জাকির হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ। আমার সংবাদের জন্য শুভকামনা।