তীব্র জ্বালানি সংকটে হুমকির মুখে শিল্প খাত। ব্যাহত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা। উদ্বিগ্ন উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প কারখানায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কমেছে উৎপাদন। অন্য দিকে ঘনঘন বিদ্যুৎবিভ্রাটে বাড়ছে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় বণিক সমিতি বিজিএমইএ বলছে, বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে হুমকিতে পড়বে দেশের তৈরি পোশাকশিল্প।
রাজধানীর সাভার শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সংকটের কারণে পোশাক শিল্প কারখানায়গুলোতে উৎপাদন অর্ধেকেরও কমে এসে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ সংকটের পর শিল্প খাতে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শতভাগ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ১০ ভাগ কিংবা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ফলে এই খাতে জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানির চাহিদা পূরণের দাবি জানিয়েছে শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর মৌচাক এলাকার চার হাজার শ্রমিকের একটি পোশাক কারখানায় তিন থেকে সাড়ে তিন পিএসআই গ্যাস হলেও কার্যক্রম অন্তত স্বাভাবিক থাকে। ক্রমান্বয়ে গ্যাসের প্রেশার কমে যাওয়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে দুই শিফটে চালাতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠাটি। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী এই শিল্প নিম্ন আয়ের মানুষের জীবিকা নির্বাহেও বড় অবদান রাখছে। ঢাকা ও তার আশপাশে গড়ে উঠা ছোট ও মাঝারি ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদার তুলনায় জ্বালানি সংকটে পড়েছে। আশাহত হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। রুটিরুজির সংস্থান হারাচ্ছে বহু শ্রমিক।
কারখানার মালিকরা বলছেন, এভাবে বিদ্যুৎবিভ্রাটের কবলে বাড়ছে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়। এতে উৎপাদনে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে অনেক। দাম বাড়ার কারণে চাহিদাও অনেকাংশই কমে যেতে পারে বলে জানান এক ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা। শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, গাজীপুরে প্রায় দুই হাজার ১৬৫টি নিবন্ধিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে পোশাক কারখানা এক হাজার ১৮৭টি। এর অধিকাংশে উৎপাদন এখন নিম্নগামী।
এদিকে সংকটের কথা স্বীকার করে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলে, আগামী দু’-এক মাসের মাসের মধ্যেই সমস্যা সমাধান হবে। নারায়ণঞ্জের চাষাড়া, ভুলতা, রূপগঞ্জ, তারাবো, গাউছিয়ায় অসংখ্য পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। উৎপাদন হ্রাসে শঙ্কিত শ্রমিক-মালিক সবাই। এক দিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া অন্যদিকে উৎপাদন হ্রাসের ফলে চাকরি হারানোর আতঙ্কে আছেন অনেক কর্মচারী। অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে না পারায় ঝুঁকি কথা কথাও জানান তারা। এদিকে সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানাসহ টেক্সটাইল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে সমহারে।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দীর্ঘ ছয় মাস ধরে প্রথমে বিদ্যুৎ সংকট ও পরে জেনারেটরে ব্যবহূত গ্যাসের সংকট তাদের বিপাকে ফেলেছে। সাভার-আশুলিয়া এলাকায় প্রায় ছয় শতাধিক নিটিং ও ডায়িং এবং চার শতাধিক টেক্সটাইল কারখানায় বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে গ্যাস জেনারেটর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে তীব্র লোডশেডিংয়ে হাহাকার অবস্থা। বিকল্প হিসেবে গ্যাস ব্যবহারে ঝুঁকেছে অনেকে। এখন গ্যাসেও সংকট। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম অসম্ভব বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। ছোট খারখানার নতুন উদ্যোক্তারা আশাহত হয়ে পড়েছেন। ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার চিন্তাও করছেন অনেকে।
আশুলিয়ার লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জেনারেটর ইনচার্জ গোলাম রসূল বলেন, বর্তমানে গড়ে প্রতিটি কারখানাতে ৫০ থেকে ২০ পিএসআই পর্যন্ত গ্যাসের চাহিদা থাকলেও তারা পাচ্ছেন গড়ে এক থেকে পাঁচ পিএসআই পর্যন্ত। এতে দিনের অধিকাংশ সময় কাজ বন্ধ করে অলস সময় পার করছেন এখানকার শ্রমিকরা।
সরেজমিন শিল্পাঞ্চলের প্রায় অর্ধশত কারখানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি কারখানাতেই গ্যাসের সংকট রয়েছে। ফলে উৎপাদনও কমে গেছে অর্ধেকের নিচে। সমস্যায় ভুগলেও শিল্প মালিক ও কর্মকর্তাদের অনেকেই অজানা শঙ্কায় ক্যামেরার সামনে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে গ্যাস সংকটে একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম একটি কারখানার এক কর্মকর্তা জানালেন তাদের নিদারুণ সমস্যার কথা।
এদিকে সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস নিতে মরিয়া শিল্পোদ্যোক্তারা। কিন্তু ওই ধরনের সরবরাহের জন্য স্টেশনগুলোতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। তারপরও দুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্যেই সিলিন্ডারে গ্যাস বিক্রি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিএনজি স্টেশন থেকে শিল্প কারখানায় সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের আইনগত অনুমোদন থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। স্টেশনগুলোতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। বিজিএমইএ ও বিসিএমইএ পেট্রোবাংলা এবং সিএনজি স্টেশন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনকে সিএনজি স্টেশনগুলো থেকে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের জন্য সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দেয়।
বিজিএমইএ থেকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের চাপ কম থাকায় এবং অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কারণে উৎপাদন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সকাল ৮টার পর থেকে গ্যাসের প্রেসার কমে কমে শূন্য পিএসআই হয়ে যায়। আবার রাত ১১টার পর কিছুটা উন্নতি হয়। ফলে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটছে। এমন অবস্থায় সিএনজি স্টেশন থেকে যে সব কারখানা গ্যাস সরবরাহ নিতে চায় তাদেরকে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করার বিষয়ে একান্ত সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু স্টেশনগুলো গ্যাস সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
সাভার আঞ্চলিক তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপক (বিপণন) আবু সাদাত মো. সায়েম শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে একযোগে গ্যাসের ওপর চাপ পড়ায় হাজার হাজার শিল্প কারখানায় সঠিকভাবে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে দুই এক মাসের মধ্যে বিকল্প পদ্ধতির মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করা হবে বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থা ও অনিশ্চিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা ঝুঁকিপূর্ণ। ২৫ ডলার (প্রতি এমএমবিটিইউ) হিসাব ধরে এলএনজি আমদানি করলেও চাহিদা মেটাতে অন্তত ছয় মাস কেনার মতো অবস্থা নেই। এ মুহূর্তে সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে আপাতত সংকট কিছুটা প্রশমনে প্রয়োজনে শিল্প মালিকরা সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস নিতে পারেন। দু’-তিন মাসের মধ্যেই ভোলা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সিএনজি আকারে জাহাজে এনে জাতীয় গ্রিডে দেয়া হবে।’
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বিদ্যুতের লোডশেডিং আরও বেড়েছে। এসব কারণে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে রেশনিং সিস্টেমে যেতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। সংকটকালে তেল ও ফার্নেস অয়েলের ওপর গড়ে ২৪ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাই।’ এদিকে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক আলোচনায় বলেছেন, শিল্প কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বৈশ্বিক এই সমস্যা সম্মিলিতভাবে সমাধান করা আবশ্যক।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘শিল্পে দিনে গ্যাস প্রয়োজন ৯০ কোটি ঘনফুট। দেয়া হচ্ছে ৫০ কোটি ঘনফুট। গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের কারখানায় গ্যাস সংকট সবচেয়ে বেশি। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে এসব এলাকার কারখানায় গ্যাস দেয়া জরুরি। অন্য খাত থেকে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হারে গ্যাস রেশনিং করে হলেও এই চার এলাকার শিল্পের চাহিদা মেটানো প্রয়োজন। আগামী তিন থেকে ছয় মাসের জন্য সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ অর্ধেক কমিয়ে এবং গ্যাসের অপচয় ১০ শতাংশ কমিয়ে আনলে দিনে ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস এই চার এলাকার শিল্পে দেয়া সম্ভব।