বৈদেশিক মুদ্রার (ডলার) সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যেই আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার আশা করছে সরকার। এ বিষয়ে আলোচনা করতে আইএমএফ প্রতিনিধিদল ১৫ দিনের বাংলাদেশ সফরে রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণ পেতে কোনো সমস্যা হবে না।
তবে আইএমএফের কাছে চাওয়া সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা কবে নাগাদ পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। মোট তিন কিস্তিতে আসবে এ ঋণ। এটা পেতে আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত লেগে যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের ঋণ দেয়ার শর্তাদি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ঋণ কত তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে— তা নির্ভর করছে সংস্থাটির সফররত প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদনের ওপর। তবে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত হতে পারে এবং ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ট্রাস্টের (আরএসটি) অধীনে ঋণ আবেদনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করতে আইএমএফ দল এখন ঢাকায়। তাদের সঙ্গে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দফায় দফায় আলোচনা চলছে। আরও কয়েক দফা এ আলোচনা চলতে পারে।
এরপর তাদের (প্রতিনিধিদল) প্রতিবেদন আইএমএফ বোর্ডে জমা দেয়া হবে। প্রতিবেদনের পরই ঋণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে আইএমএফ। যদিও ঋণের প্রথম কিস্তি কবে পাওয়া যাবে, সেটি এখনো নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে ধরা হচ্ছে।
যদিও দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইএমএফের শর্ত মেনে নিলে ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া সম্ভব। তবে সে ঋণ পরের বছরের শুরুতে অর্থাৎ আগামী জানুয়ারিতে মিলতে পারে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, সফররত প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদন আইএমএফ বোর্ডে জমা দেয়া হবে। প্রতিবেদনের পরই ঋণ পাওয়া যাবে। আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ সবশেষ ২০১২ সালে ঋণ নিয়েছিল। যার পরিমাণ ছিল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। ওই সময় ঋণ নেয়ার আগে করনীতিতে কিছু সংস্কার এবং ভ্যাট চালু করা হয়। তবে তারা মুদ্রার বিনিময় ও সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফের সব শর্ত মেনে নিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ ঋণ পাওয়াটা জরুরি। এ ঋণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরবর্তীতে ঋণ পাওয়ার পথ। যদি এ ঋণ না পাওয়া যায়, তবে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে ঋণ পাওয়া দুরূহ হয়ে যাবে। আইএমএফের প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে আগামী ডিসেম্বরে ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে। পরের দুই ধাপের কিস্তি ছাড় হবে শর্তগুলো পূরণসাপেক্ষে। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ মনে করে, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফসহ বিভিন্ন তহবিলে সরবরাহ করা সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারকেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে দেখাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংস্থাটি বলছে, আন্তর্জাতিক হিসাব পদ্ধতির সঙ্গে যা সংগতিপূর্ণ নয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করতে গত বছর থেকে বলে আসছে তারা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও নিজেদের মতো করেই হিসাব করছে। আইএমএফের মতে, আপদকালীন আমদানি দায় পরিশোধের মতো অর্থই রিজার্ভ। আর ইডিএফসহ বিভিন্ন তহবিলে সরবরাহ করা অর্থ ‘রেসিডেন্ট টু রেসিডেন্ট’ দায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব হয় আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম৬) ম্যানুয়াল অনুসারে।
গত বছরে সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে। সে সময় আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করে রিজার্ভের হিসাব করার পরামর্শ দেয়া হয়। রিজার্ভের এ হিসাব চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংশোধন করার কথা ছিল। তবে এখনও বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে (ইডিএফ) সরবরাহ করা সাত বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ২০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে দেখাচ্ছে।
তাছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডে (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে তিন কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে চার কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশনে আমানত রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে রিজার্ভে যে অর্থ দেখানো হচ্ছে, সে রিজার্ভ থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশের রিজার্ভ এখন ৩৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করলে রিজার্ভ দাঁড়াবে ২৭ দশমিক চার বিলিয়ন ডলারে।