আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বাংলাদেশের সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের বিষয়ে সংস্থাটির প্রতিনিধি দলের সাথে দ্বিতীয় দিনের মতো গতকাল দিনভর বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা। বৈঠকে জোড়ালোভাবে কয়েকটি বিষয় জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
ঋণখেলাপি বন্ধে পদক্ষেপ, ডলার বাজার, মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রভাব, আর্থিক খাতের বিভিন্ন সূচক ও আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ভূমিকাসহ টেকসই অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রতিনিধি দলটি। এসময় খেলাপি ঋণ বন্ধের পদক্ষেপ সম্পর্কে জোড়ালোভাবে জানতে চাওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকের অব্যাহত খেলাপি ঋণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ আমার সংবাদকে বলেন, আইএমএফ প্রতিনিধিরা আমাদের কাছে খেলাপি ঋণ বন্ধের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমরা তাদের মাস্টার সার্কুলার (বিআরপিডি সার্কুলার-১৬) সম্পর্কে অবহিত করেছি। এছাড়া আর্থিক অপরাধের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। আমরা জানিয়েছি, ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে কিছু বিষয় যেহেতু সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট তাই সেসব বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এটি এ খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকালে প্রথম অধিবেশনে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাথে আলোচনায় বসেন আইএমএফ প্রতিনিধিরা। এতে এএমএল/সিএফটি ঝুঁকি-ভিত্তিক তত্ত্বাবধান ও অন্যান্য প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা হয়। এরপর ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ ও ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের পরিচালকদের সাথে আলোচনা হয়। এতে আর্থিক খাতের ডেটা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় সংস্থাটি। পরিসংখ্যান বিভাগের সাথেও বসেন আইএমএফ প্রতিনিধিরা। এতে বিওপি সম্পর্কিত প্রযুক্তিগত বিষয় জানতে চাওয়া হয়।
তৃতীয় অধিবেশনে গবেষণা বিভাগ, মনিটারি পলিসি ডিপার্টমেন্ট, চিফ ইকোনমিস্টস ইউনিট, ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট এবং সচিব বিভাগ ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগের সাথে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে— প্রত্যাশিত মুদ্রাস্ফীতির উন্নয়ন এবং এমপির অবস্থানের বর্তমান মূল্যায়ন, দ্বিতীয় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব; যেকোনো প্রত্যক্ষ মূল্য নিয়ন্ত্রণ পরিমাপ, মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা সমীক্ষার ফলাফল, বিনিময় হারের চাপ এবং প্রত্যাশিত উন্নয়ন। এছাড়া সুদের হার করিডোর সিস্টেম বাস্তবায়নে বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ এবং সময়সীমা, প্রতি বছর দুই এমপিএস ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানোর বর্তমান অবস্থা, আইআর নীতি বাস্তবায়নে অগ্রগতি এবং সামনের চ্যালেঞ্জ, প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন এবং সুশাসনকে শক্তিশালী করার জন্য ২০২২ আইএমএফের সেফগার্ডস অ্যাসেসমেন্টের সুপারিশের পরিচালন বিষয়ে আলোচনা হয়।
এছাড়া ব্যাংক টু ব্যাংক পর্যালোচনা এবং সেক্টরভিত্তিক আর্থিক সূচকগুলোর ওপর আপডেট (২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত) এফএসআই সংগ্রহ, সংকলন এবং প্রকাশ করার পরিকল্পনা, সামপ্রতিক আইএমএফ সম্মেলনের প্রতিফলন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রোডম্যাপ এবং অনসাইট এবং অফসাইটের কার্যক্রম এবং ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যাংকের তত্ত্বাবধান আপডেট বিষয়ে ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্ট ও অফসাইট সুপারভিশন ডিপার্টমেন্টের সাথে আলোচনা হয়েছে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক-এসওসিবির অধীনে এমওইউ’র সংস্কার ও কর্মক্ষমতার অবস্থা। বাণিজ্যিক ব্যাংক, সহযোগী প্রতিষ্ঠান, ইক্যুইটি বাজার, সামপ্রতিক ক্রিয়াকলাপ এবং ঝুঁকিবিষয়ক আপডেট, ১০টি ব্যাংকের সাথে পাইলট প্রকল্পের অবস্থা, ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির উন্নতি ও ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য সংস্কার, অগ্রাধিকার-ভিত্তিক পাঁচটি প্রধান আইন চূড়ান্তকরণের অবস্থা এবং সংসদীয় অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চায় প্রতিনিধি দল। ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিকালে সার্বিক বিষয়ে গভর্নরের সাথে বৈঠকের মাধ্যমে আলোচনা শেষ হয়। এ সময় টেকনিক্যাল মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (টিএমইউ), মেমোরেন্ডাম অব ইকোনমিক অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল পলিসিজ (এমইএফপি) চূড়ান্তকরণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র।
জানা গেছে, ডলারের একরেট নির্ধারণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত পদক্ষেপ নিতে চাইছে না। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আগামী ৩-৬ মাসের মধ্যে একটি কাছাকাছি দর নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনই একরেট নির্ধারণ না করে সময় নিয়ে একরেট নির্ধারণ করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, ডলার বাজার স্থিতিশীল করতে ডলারের একরেট নির্ধারণে জোড়ালোভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অন্যদিকে এখনই বিনিয়োগ ও আমানতে সুদহার তুলে নেয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ক্যাপ তুলে নেয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এটি রিফর্ম করার বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এটি রিফর্ম হতে পারে। কিন্তু ক্যাপ তুলে নেয়া হচ্ছে না এটি নিশ্চিত।
সমপ্রতি ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। সভার এক ফাঁকে আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল। আলোচনায় বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার আশ্বাস পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। তবে এ ঋণ তিন কিস্তিতে দেয়া হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় ঋণ কর্মসূচি ছাড়াও আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাকিং খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা করতে গত বুধবার ১৫ দিনের সফরে ঢাকায় এসেছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইএমএফের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। তিনি সংস্থাটির বাংলাদেশ মিশনেরও প্রধান। ঢাকায় অবস্থানের সময় অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিকল্পনা কমিশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করবে সংস্থাটি।