বিশেষায়িত খামারে ঝুঁকছেন তরুণরা

বেলাল হোসেন প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২২, ০১:৫০ এএম
বিশেষায়িত খামারে ঝুঁকছেন তরুণরা

শখের বসে অনেকেই পশুপাখি পালন করে থাকেন। সেই শখ থেকেই দেশে তৈরি হচ্ছে সফল উদ্যোক্তা। অনেকেই তাদের সাফল্যগাথা কাজে দেশের প্রাণিজ আমিষে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। হাঁস, তিতির পাখি, কোয়েল ও কবুতর পালনে ঝুঁকছেন তরুণ উদ্যোক্তা। এসব বিশেষায়িত খামার থেকে অনেকেই আয় করছেন লাখ টাকা। পশু-পাখি পালনে অনেকেই হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী। বিভিন্ন ব্যবসার পাশাপাশি কবুতর, তিতির পাখি, কোয়েল পাখির খামার করে এগিয়ে যাচ্ছেন। যা দেশের জনগণের পুষ্টি জোগানেও ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন খামারিরা। বর্তমানে গরু, মহিষ, খাসি কিংবা ভেড়ার মাংসের দাম অনেক বেশি, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এ অবস্থায় পোল্ট্রির মাংসের দাম কিছুটা হাতের নাগালে। এর পাশাপাশি হাঁস, তিতির, কোয়েল ও কবুতর খামারিরা স্থানীয় পর্যায়ে আমিষের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন।

দেশে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রারকৃত হাঁসের খামার আট হাজার ১০৭টি। কবুতরের খামার ৩০টি। এর বাইরে হাঁস ও কবুতরের খামার দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং বাসা বাড়িতে মানুষ এগুলো পালন করে থাকে। এছাড়া বিদেশি জাতের মুরগির সাথে বিশেষায়িত খামার করছেন অনেক উদ্যোক্তা। বিদেশি জাতের মুরগির সাথে তিতির পাখি, কোয়েল পাখির খামার করে সফলতার মুখ দেখছেন অনেকে। আমার সংবাদের সাথে কথা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর থানার সফল বিশেষায়িত খামারি জাহিদ উদ্দিনের। মা-বাবা দোয়া হ্যাচারি অ্যান্ড সেলস সেন্টার গড়ে তুলেছেন এ উদ্যোক্তা।

জাহিদ উদ্দিন প্রায় ছয় বছর ধরে এ খামার পরিচালনা করে আসছেন। জাহিদ বলেন, আমার খামারে ছোট-বড় মিলিয়ে ৭০০ তিতির পাখি আছে। ১২ হাজার কোয়েল পাখি আছে। মিসরীয় ফাহমি জাতের মুরগি আছে সাত হাজার। দেশি মুরগি ছোট-বড় মিলিয়ে ৮০০টি। বর্তমান খামারে প্রায় ৯ জন শ্রমিক কাজ করে। ছোট-বড় মুরগিদের খাবারে একটু তারতম্য আছে। প্রতিদিন পাঁচ বস্তা করে খাবার প্রয়োজন হয়। এতে প্রায় ১৬  হাজার টাকা ব্যয় হয়। মাসে সব কিছু বাদ দিয়ে ৬০-৭০ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানান জাহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, খামারের প্রাণিসম্পদগুলো কাঁচামাল।

এগুলোর অবস্থান সব আল্লাহর হাতে। যদি সব সময় দেখাশোনা ঠিকমতো করা যায় তাহলে মোটামুটি লাভ আসে। শ্রমিক খরচ, বিদ্যুৎ খরচ, খাবার খরচ আবার কিছু বাচ্চা মারা যায় এরকম কিছু ঘাটতি মিলিয়ে মাসে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানান জাহিদ উদ্দিন।

খামারের পাখি-মুরগিদের চিকিৎসা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমের দিকে বেশি কিছু জানা ছিল না। আস্তে আস্তে ঠেকে শিখছি। এখন আইডিয়া হয়ে গেছে, আর সমস্যা হয় না। বর্তমানে আমি যা জানি এর মধ্যে থেকে খামারের প্রাণিগুলোর চিকিৎসা করতে পারি। এর বাইরে আমার কাছ থেকে যারা বাচ্চা, বড় মুরগি পাখি ক্রয় করে তাদেরও সহযোগিতা করছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে আমার কাছে কোয়েল পাখি, তিতির ও বড় মুরগি নেয়। তিতির পাখি বেশির ভাগ ক্রেতা এক থেকে দেড় মাসের বাচ্চা নেয়। এটিতে ঝুঁকিমুক্ত। আমরা এর মধ্যে একটি ভ্যাকসিন করে দেই— এতে করে তিতির পাখির আর তেমন বড় রোগবালাই হয় না।

জাহিদ আরও বলেন, একটা তিন মাস বয়সের তিতির পাখির খরচ আসে ২৫০-২৭০ টাকা। নতুন উদ্যোক্তার বিষয়ে তিনি বলেন, অবশ্যই একজন নতুন খামারিকে একটি পরিচালিত খামার দেখেশুনে ভালোভাবে বুঝে আসতে হবে। কারণ এটি রিস্কের ব্যবসা। আর ব্যবসায় লস-লাভ থাকেই। খামারের পরিচর্যা নিজে ভালোভাবে করলে এ খামার থেকে লাভ আসবে বলে জানান এই খামারি।  

প্রাণিজ সেক্টর দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাত উল্লেখ করে জাহিদ বলেন, আমাদের দেশের ছোট-বড় মিলিয়ে প্রতিটি খামারে কিন্তু দুই-চারজন লোক শ্রম দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি আমাদের আরও উৎসাহ দেয়, সহযোগিতার হাত আর একটু বাড়িয়ে দেয় তাহলে যারা ছোট ছোট খামারি আছে তারা আরও এগিয়ে আসবে। তিনি বলেন, সরকার যাদেরকে লোন সহায়তা, বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে ওই খামারিকে যাচাই করে নিতে হবে। আসলেও কি সে প্রকৃত খামারি, না সে অন্য কোথাও টাকা নিয়ে কাজ করবে তা দেখা প্রয়োজন। তাহলে হয়তো এই সেক্টরের উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।

রাজধানীর আগারগাঁও তালতলার কবুতর খামারি অপু। বেশির ভাগ বিদেশি জাতের কবুতর তিনি বেশি পালন করেন। তার সংগ্রহে আছে ফেন্সি জাতের কবুতর সাত শতাধিক। এর মধ্যে ফ্যানটাইল, আমেরিকান ফ্যানটাইল, ইংলিশ ফ্যানটাইল, এক্সিবিশন হোমার, জার্মানি বিউটি হোমার, লাহোড়ি, হাঙ্গেরিয়ার হাউজ পিজিয়ন, মুন্ডিয়ান কবুতর, ডেনিশ জাত, মিসরীয় মোরাস্ল্যাট ইত্যাদি। অপু বলেন, তার আলাদা ব্যবসা আছে। এর পাশাপাশি বাড়ির ছাদে পাঁচটি শেডে প্রায় এক হাজার কবুতর লালন পালন করেন। ফেন্সি জাতের সর্বনিম্ন কবুতরের দাম ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ দাম দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা জোড়া। এ ছাড়া ইজিপশিয়ান একজোড়া কবুতরের দাম এক লাখ টাকা আর বাচ্চা ২৫ হাজার টাকা। লাহোড়ি কবুতর ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা জোড়া।

কবুতর খামারি অপু বলেন, তিনজন শ্রমিক এখানে কাজ করে। বিদেশি কবুতর হলেও এদের দেশি খাবার গম, ভুট্টা, ধান খাওয়ানো হয়। ভালো খাবার পানি কবুতরকে দেয়া হয়। খাবার দুবেলা দেয়া হয়। তিন থেকে চার ঘণ্টা পর খাবার পানি পরিবর্তন করে দেন বলে জানান তিনি। চিকিৎসার বিষয়ে খামারি জানান, বছরে তিনবার ভ্যাকসিন দেয়া হয়। বাংলাদেশি আরডিবি ভ্যাকসিন চার মাস অন্তর অন্তর দেয়ার কথা জানান। এ ছাড়াও বছরে একবার কৃমির ওষুধ খাওয়ান।

অপু বলেন, কবুতরের খামার থেকে মাসে প্রায় লাখ টাকার মতো আয় হয়। অপুর মতো রাজধানীসহ সারা দেশে অনেকেই দেশি-বেদেশি নানান জাতের কবুতর লালন পালন করছেন। অনেকেই এখন কবুতর পালনকে বাণিজ্যিকভাবে নিয়েছেন। অনেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছেন। প্রতিটি অঞ্চলে সপ্তাহে একবার কবুতর বেচাকেনার হাট বসে। মূলত সেখান থেকেই এসব কবুতর পালনের জন্য মানুষ ক্রয় করে থাকে। এ ছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু মার্কেটেও বিভিন্ন জাতের কবুতর পাওয়া যায়।

বাগেরহাট সদরের কোয়েল পাখির খামারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান বলেন, ২০২০ সালে অল্প পরিসরে কিছু কোয়েল পাখি পালন শুরু করি। তিনি বলেন, দেশি মুরগি খামারের পাশাপাশি কোয়েল পাখি পালন শুরু করি। গরমের সিজনে পাখি ছিল প্রায় ১৮ হাজার। এখন সাড়ে ১৪ হাজার কোয়েল পাখি আছে। শীতের সিজনে আবার কোয়েল পাখি আরও বাড়বে বলে জানান মেহেদি হাসান। গরমের মধ্যে একটু সমস্যা হয়। এখন খাবারের দাম বেশি তবে ডিম ও মাংসের দামে কিছুটা লাভ হচ্ছে বলে জানান এই খামারি। তিনি বলেন, একটা কোয়েল পাখির বয়স ৩০ দিন হলে মাংসের জন্য বিক্রি করা যায়। আর বয়স ৪৫ থেকে ৬০ দিন পরিপূর্ণ হলে এগুলো ডিম পাড়া শুরু করে। বর্তমানে ১০০ কোয়েল পাখির দাম দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার টাকা। আর এক হাজার ডিম বিক্রি হয় দুই হাজার ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। তিনি বলেন, কোয়েল পাখির পাশাপাশি বর্তমানে দেশি মুরগি ও হাঁস পালন করা হয়। খাবারের দাম বৃদ্ধির এই বাজারে সব মিলিয়ে ভালো চলছে বলে জানান মেহেদি হাসান।

স্থানীয় পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নিজেই খামারের প্রাণি পরিচর্যা শিখে গেছি এখন আর সমস্যা  হয় না। তিনি আরও বলেন, যারা প্রকৃত খামারি তারা যেন সরকার এবং বেসরকারি পর্যায় থেকে সহজ শর্তে ঋণ পায়। অথচ যারা ঠিকমতো খামারের সাথে যুক্ত নয় তারা অনেক টাকা পর্যন্ত ঋণ সহায়তা পাচ্ছেন। প্রকৃতরা এ সহায়তা পাচ্ছেন না। ঋণের জন্য আবেদন করলে অনেক ডকুমেন্ট চায় অথচ বড় বিনিয়োগ করেও তেমন  কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না বলে অভিযোগ করেন মেহেদি হাসান।

পাবনা চাটমোহর উপজেলার মুলগ্রাম পাতালহাটের হাঁস খামারি আফাজ উদ্দিন প্রামাণিক। কথা হয় আমার সংবাদের সাথে। তিনি বলেন, আট মাস আগে ৮০০ হাঁস নিয়ে খামার শুরু করি। বর্তমানে ৫০০ হাঁস আছে। এখন ৬০ শতাংশ ডিম পাড়ে। বাচ্চা যখন সাড়ে তিন মাস বয়সে পরিপূর্ণ হয় তখন ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ডিম পাড়ে। আফাজ বলেন, একবার ডিম দেয়া হয়েছে। কিছু পরে আবার এখন মোটামুটি আবার শুরু হয়েছে। এখন প্রতিদিন প্রায় ২৬০-৩০০ ডিম পাওয়া যায় বলে জানান এ খামারি। বর্তমানে ১০০ ডিমের দাম  এক হাজার ৪৮০ টাকা। বর্তমানে ৫০০ হাঁসের প্রতিদিন দুবার খাবার দিতে হয়। এতে খরচ হয় প্রায় ৯০০ টাকা। আবার যখন মাঠে ধান থাকে না তখন খাবার দিতে হয় না। অনেক তরুণ দূর-দূরান্ত থেকে এসে খামারের বিষয়ে জানতে চান। অনেকে খামার করেছেন বলে জানান এই কৃষক। তিনি বলেন, প্রায় ১০-১২ বছর হলো আমি অল্প পরিসরে হাঁস পালন করতাম। এখন এ থেকে ভালো লাভ হয়। এ জন্য বড় করে খামার করেছি।

ভবিষ্যতে আরও বড় করার পরিকল্পনা আছে বলেও জানান তিনি। হাঁসের চিকিৎসা বিষয়ে খামারি বলেন, প্রথমে বাচ্চা নিয়ে ১৫ দিন পর একটি ভ্যাকসিন আর যখন বয়স দুই মাস হয় তখন একটি ভ্যাকসিন দিতে হয়। আর যখন বৃষ্টি হয় বা ঠাণ্ডা লাগে তখন একটু ওষুধ দিয়ে দিলে আর সমস্যা হয় না। প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে প্রথম দিকে ওষুধ এনে খাওয়ানো হয়েছিল তবে বেশি উপকার পাইনি। নিজে নিজে এখন সব কিছু শিখে গেছি, কখন কোন ওষুধ লাগবে সেটি আর সমস্যা হয় না। ডিম পাড়া হয়ে গেলে অনেক সময় পাখা পড়ে যাওয়া হাঁসের অবস্থা বুঝে ৩৫০-৪০০ টাকা পর্যন্ত মাংসের জন্য বিক্রি করা হয়।

পাবনা চাটমোহর উপজেলার প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মো. নূরে আলম বলেন, ‘আমাদের উপজেলায় ৬২টি হাঁসের খামারে মোট ৮০ হাজার ২৯২টি হাঁস আছে। এর বাইরেও অনেকে পালন করে। কবুতরের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার ৬৪৩টি।’ তিনি বলেন, ‘বিল, বাওর এলাকা এ জন্য এখানে হাঁস মোটামুটি আছে। গত বছরের চেয়ে বন্যা এবার কম। পানি বেশি হলে হাঁস বেশি পালন করে থাকে। আবার পানি কম হলে হাঁস পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে।

চিকিৎসার বিষয়ে ডা. নূরে আলম বলেন, ‘কেউ চিকিৎসার জন্য এলে আমরা পরামর্শ সহায়তা দিয়ে থাকি, ওষুধপত্র থাকলে দেই। বড় খামারিদের তো ওইভাবে ওষুধ দেয়া সম্ভব হয় না। তাদের পরামর্শ দেই। বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি আছে তাদের কাছ থেকে অনেকেই সহায়তা নিয়ে থাকেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) পরিচালক মো. আব্দুর রহিম আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা বিশেষায়িত খামারগুলোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। সৌখিন লোকজন, যারা কিনা নতুন আইডিয়া নিয়ে খামার করছেন তারাই বিশেষায়িত খামারের প্রতি ঝুঁকছেন।’ তিনি বলেন, ‘এ সব খামারি চিকিৎসা সহায়তা, পরামর্শ পাচ্ছেন।’

প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘আমাদের প্রকল্পে যে সার্ভে করেছি এবং ডিপিপিতে বিশেষায়িত ফার্মের কথা উল্লেখ আছে— আমাদের সহযোগিতার আওতার মধ্যে তারা আছেন। এখনই তো প্রডিউসর গ্রুপ (পিজির) মতো কোয়েল পাখি, তিতির পাখি খামারিদের পিজি গ্রুপ করা সম্ভব নয়। তবে অদূর ভবিষ্যতে এসব খামারিদের নিয়েও ভালো কিছু কাজ করা হবে জানান এলডিডিপির প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুর রহিম।