হেফাজতের শীর্ষ মুরব্বিদের বড় অংশই মৃত্যুবরণ করেছেন। মাঠ পর্যায়ের তরুণ নেতারা কারাগারে। নেতৃত্বশূন্য হয়ে দীর্ঘ সময় নীরব থাকলেও আবারও মাঠে নামছেন তারা। আগামী মাসে ঢাকায় সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন। তার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করবেন। দলের সব নেতাকর্মীর মুক্তির আহ্বান জানাবেন। লিখিতভাবে দাবি তুলে ধরবেন। সরকারের আরো শীর্ষ নেতাদের সাথেও দেখা করবেন।
যদি ১৭ ডিসেম্বরের আগে সব নেতাকে মুক্তি দেয়া না হয় তাহলে ঢাকার সম্মেলন থেকে সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়া হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে আবারও আগের মতো বড় কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে করণীয় ঠিক করা হবে। অতীতের আঘাতের বিষয়ে জবাব দেয়ার সুযোগ এলে ছাড় দেয়া হবে না। হেফাজতের শীর্ষ মুরব্বিরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তারা জানিয়েছেন, শীর্ষ নেতাদের হারিয়ে, তরুণ নেতাদের কারগারে রেখে দলে কিছুটা শূন্যতা থাকলেও দেশের সব নাগরিক ও যে সব রাজনৈতিক দল ইসলামকে ভালোবাসে তারা হেফাজতের ডাকে ২০১৩ সালের ৫ মের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। এ জন্য সব আলেমের মুক্তি দাবিতে বিশেষ দফায় খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। ৫ মের ঘটনায় মানবাধিকার সংস্থাগুলোতে অভিযোগ দেয়ার প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে।
হেফাজতে ইসলামের ওপর দেশের নাগরিকদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা আছে— তা সময়ের আলোকে কাজে লাগানো হবে। তারা শুধু হেফাজতের আলেমদের মুক্তি নয়, সব বন্দি আলেমের মুক্তি দাবিতেও কর্মসূচির কথা চিন্তা করছে। অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দল থেকেও সমর্থন পাবে বলে মনে করছে। ঈমানি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তারা পুরোনো ইমেজ ধরে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। এদিকে হেফাজতের ভাবনা নিয়ে দৃষ্টি রেখেছে বিএনপিও।
গত মঙ্গলবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভা থেকে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নির্মম হামলা ও হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হয়েছে এবং পুনরায় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বানও জানানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বন্দি নেতাদের মুক্তি দাবিতে এবার কোমর বেঁধে মাঠে নামবে হেফাজত। আগামী ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে সম্মেলনের ডাক দেয়া হয়েছে। গত সোমবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভায় এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সভায় কারাবন্দি আলেম-ওলামা ও হেফাজত নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে করণীয় ঠিক করা হয়েছে।
বিগত ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করবেন। চিঠির মাধ্যমে প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হবে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে দলটির পরিধিও আরো বাড়ানো হবে। এরই মধ্যে ওই বৈঠকের মাধ্যমে হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরীর কমিটির আকার বাড়ানো হয়েছে। গঠন করা হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরীর আহ্বায়ক কমিটিও।
এছাড়া সারা দেশে জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামকে সুসংগঠিত করতে মহাসচিবের নেতৃত্বে আরো একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় সংগঠনের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দলটির প্রতি দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন ও আন্দোলনের চিন্তা করলে সরকারের কী ভূমিকা হবে এ বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনায় হয়। দলটিতে যারা নেতৃত্বে রয়েছেন তারা অধিকাংশই বয়স্ক, মুরব্বি। অনেকে অসুস্থ। মাঠপর্যায়ের ভূমিকা কতটা সফল হবে এমন প্রশ্নে দেশের মানুষ সাথে থাকবে, কিছু রাজনৈতিক দলেরও সমর্থন থাকবে, কারাগারে নেতাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করা ঈমানি অংশ বলেও কেউ কেউ মত দিয়েছেন। মুক্তির বিষয়ে ঝুঁকি নিয়ে হলেও ভূমিকা রাখতে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত হয়েছে। তা ছাড়া আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আলেমদের মুক্তির দাবিতে অন্যা দলগুলোও আন্দোলনের চিন্তা করছে। সে ক্ষেত্রে হেফাজতও পিছিয়ে থাকবে না। দলটির তরুণ নেতারা এবার আন্দোলনে বেশি মনোযোগী হচ্ছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলটির নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পুরোনো ও নতুন মামলায় দুই ডজন হেভিওয়েট পার্সনসহ অর্ধশতাধিক নেতা আটক আছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, সংগঠনটির সহকারী মহাসচিব মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন , তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মুফতি হারুন ইজহার চৌধুরী, খতমে নবুওয়ত আন্দোলনের আমির ও হেফাজতে ইসলামের নেতা মুফতি নুর হোসেন নুরানী, যুগ্ম মহাসচিব নাসির উদ্দিন মুনির, আলোচিত বক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানী, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফ উল্লাহ, হেফাজত নেতা লোকমান হোসেন আমিনী, মাওলানা মহিউদ্দিন, মাওলানা শাহজাহান শিবলী ও মাওলানা মোয়াজ্জেম, মুফতি আজহারুল ইসলাম, মাইনুল ইসলাম খন্দকার, মাহমুদুল হাসান গুনবী, মাওলানা ফয়সাল মাহমুদ। এ ছাড়া ও ঢাকা মহানগর ও চট্টগ্রাম হাটহাজারীতে অনেক ছাত্র আটক রয়েছে।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল মোট ৪৪টি? তার মধ্যে ১৩টি ইসলামিক দল। হেফাজতে ইসলামের দাবি, তারা একটি অরাজনৈতিক সামাজিক ইসলামি সংগঠন। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার মাধ্যমে তারা আলোচনায় আসেন। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে হেফাজতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। শাপলা চত্বরের ঘটনায় জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেপ্তার করা হলেও তখনকার হেফাজত আমির মাওলানা শাহ আহমদ শফীকে সরকারি উদ্যোগে নিরাপদে হাটহাজারীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাবুনগরী পরে জামিনে ছাড়া পেলেও আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী অবস্থান থেকে সরে যায়নি।
তবে আহমদ শফীর সাথে সরকারের সখ্যতা বাড়ে। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর কওমি আলেমদের উদ্যোগে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘শোকরানা মাহফিল’-এর আয়োজন করা হয়। ওই মাহফিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহমদ শফীর সাথে এক মঞ্চে বসে কুশল বিনিময় করেন। এক পর্যায়ে ওই কর্মসূচি থেকে শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর কিছু সময় সরকারের সাথে ভালো সময় যেতে থাকলেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে গত বছরের ২৬ ও ২৭ মার্চ বাংলাদেশে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুরু থেকেই মোদির সফরের বিরোধিতা করে আসছিল হেফাজতে ইসলাম। মোদি আসার আগে থেকেই নানা কর্মসূচি পালন করে হেফাজত। মোদি এলে বিক্ষোভ ও হরতাল করে সংগঠনটি। এসব কর্মসূচিতে রাজধানী ঢাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাণ্ডব চালায় হেফাজত। এ সময় হেফাজত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জনেরও বেশি নিহত হন। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের হয় অনেক মামলা। পুলিশ ও বিভিন্ন ব্যক্তি বাদী হয়ে করেন এসব মামলা।
এসব ঘটনার পর সর্বশেষ হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডের পর সংগঠনটির ওপর কঠোর অবস্থানে যায় সরকার। একে একে গ্রেপ্তার করা হয় হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের। সর্বশেষ হেফাজতের হেভিওয়েট নেতা মামুনুল হককে গত বছরের ১৮ এপ্রিল গ্রেপ্তার করা হয়। সেই থেকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে হেফাজতের বৈঠক হয়। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা ইয়াহিয়াসহ সংগঠনের ছয় সিনিয়র সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে সচিবালয়ে বন্দি নেতাকর্মীদের নিজেদের জিম্মায় জামিনের ব্যবস্থা করতে বৈঠকে বসেন। সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে অনেক নেতাই মুক্তি পেয়ে যায়। তবে এখনো বড় অংশ বন্দি।
সংশ্লিষ্ট বিষয় ও আগামীর ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতের প্রচার সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের বয়স হয়েছে। আমরা আর আগের মতো একসাথ হতে পারি না। সবাই বুড়ো মানুষ। বহুদিন পর আমরা একসাথ হয়েছি। আমারা ঢাকায় একটি কর্মসূচি দিয়েছি। সেখান থেকে আমরা সরকারকে জানাবো, যাতে আমাদের সব নেতাসহ আলেমদের মুক্তি দেয়া হয়। আর যদি মুক্তি দেয়া না হয় তাহলে আমরা অন্য কিছু সময়ের আলোকে চিন্তা করব। তার আগে আমাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তা চলছে। আর সামনে জাতীয় নির্বাচন। অনেক পরিস্থিতিই আসবে। আমরা সব পরিস্থিতিতে আলেমদের ওপর নির্যাতন বন্ধ ও মুক্তি চাই।’
এদিকে হেফাজতের চিন্তা ভাবনার বিষয়টি বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে অ্যাজেন্ডা হিসেবে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ‘অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ‘বিএনপির দশা হেফাজতের মতো হবে’ উক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে আমাদের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। সভা মনে করে— এই উক্তি, উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিরোধী দলের সংবিধানসম্মত গণতান্ত্রিক কর্মসূচিগুলোকে বাধাগ্রস্ত করার হুমকি।
৫ মে ২০১৩ তাহলে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এই নিপীড়নকারী কর্তৃত্ববাদী, একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী সরকার যেভাবে অসংখ্য আলেম ওলামা ও মাদ্রাসার কিশোর ছাত্রদের হত্যা করেছে এবং পরবর্তীতে অসংখ্য হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে অনেককে এখনো কারাগারে আটক রেখেছে— এটি তারই স্বীকারোক্তি। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের হয়রানি, মিথ্যা মামলা ও নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।
ইতোপূর্বেও বিএনপি এই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ও প্রতিবাদ করেছে। শেখ হাসিনার এই উক্তির কারণে দেশে পুনরায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের আইনসম্মত কর্মসূচি বানচাল করার চক্রান্ত বলে প্রতীয়মান হয়। বিএনপি হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নির্মম হামলা ও হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত আগেও দাবি করেছে এবং পুনরায় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করছে।’