প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তির মাইলফলক স্পর্শ করল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অসামপ্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ এ যুব সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।
গত পাঁচ দশক ধরে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও হাজারও নেতাকর্মীর আত্মত্যাগের মাধ্যমে সেই যুবলীগই আজ দেশের বৃহত্তম যুব সংগঠন। এরই মধ্যে গতকাল শুক্রবার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উদযাপিত হয়েছে সংগঠনটির সুবর্ণজয়ন্তী।
৫০ বছর উদযাপনের ইতিহাসে অংশ নিতে দিনের শুরুতেই সারা দেশ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশস্থলে দলে দলে আসতে শুরু করেন নেতাকর্মীরা। যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরাও ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আসেন সমাবেশস্থলে। সকাল থেকেই মহাসমাবেশের আশেপাশে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দোয়েল চত্বর ও রমনা পার্ক এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে নেতাকর্মীদের স্লোগানে।
তারা বলেন, ‘একাত্তরের অপশক্তি আবারো জাগ্রত হয়েছে। দেশের শৃঙ্খলা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করতে চাচ্ছে। তাদের সব অপচেষ্টা, অপকৌশলকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দিতে প্রস্তুত আমরা।’ মহাসমাবেশ শুরুর আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতাকর্মীদের ঢল নামে।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য, দুপুরের আগেই আড়াই লাখেরও বেশি নেতাকর্মী সমবেত হন সমাবেশস্থলে। নীল, সবুজ, হলুদসহ নানা রঙের টি-শাট ও টুপি পরে হাজারো নেতকর্মী বাস, পিকআপ, মোটরসাইকেলে করে আসেন মহাসমাবেশে। অনেকে আবার হেঁটে মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যান। মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গতকাল উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় উদ্যান এলাকায়।
এরপরই এক এক করে মঞ্চে আসেন সংগঠনটির সাবেক ও বর্তমান নেতারা। পরস্পর বক্তব্যে বিএনপি দুই-একটি সমাবেশ করে যে আতঙ্ক ছড়াতে চায় তার জবাব দিতে আওয়ামী যুবলীগ প্রস্তুত বলে মন্তব্য করেন।
যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, ‘যারা সমাবেশে লোকের উপস্থিতি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে গেছেন, মনে করেছেন এতেই ক্ষমতায় চলে আসছেন। তারা আজ দেখেন, আপনাদের কথা আর দুই-একটি কর্মসূচিতে সরকার পড়ে যাবে না। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করেছেন। অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। শত শত নারীর সম্ভ্রম আপনার নষ্ট করেছেন। এই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই যুবসমাজ ঐক্যবদ্ধ।’
সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘পাগলে কি-না কয়, ছাগলে কি-না খায়? ওরা পাগল, ওরা খুনি। তারেক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত, খালেদা জিয়াও তো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তারা আবার ভয় দেখায়। বলে, আওয়ামী লীগ পালাবার পথ পাবে না। আওয়ামী লীগ পালানোর দল না।’
সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ক্লিন হার্ট অপারেশনের নামে শত শত যুবলীগ নেতাকর্মী হত্যা করেছিলেন। আজকে তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বাংলাদেশে আতঙ্ক ছড়াতে চায়। তাদের যথাযথ জবাব দিতে প্রস্তুত এই যুবসমাজ।’ সাবেক ও বর্তমান নেতাদের বক্তব্য চলাকালে দুপুর আড়াইটার দিকে যুব মহাসমাবেশে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার উপস্থিতিতে আনন্দে স্লোগানে স্লোগানে ফের প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দীর সমাবেশস্থল।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর পায়রা উড়িয়ে উদ্বোধনের মাধ্যমে শুরু হয় মহসমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা। প্রথমে মঞ্চে ওঠেন কণ্ঠশিল্পী মমতাজ এমপি। তার গানে মাতে পুরো সমাবেশস্থল। গানে গানে আর পতাকা দোলানের তালে তালে দৃশ্য ছিল উপভোগ্য। বিশেষ করে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে ‘তুমি ফিরে এসেছিলে...এবং শেখ হাসিনাকে নিয়ে আরেক গান— ‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা’ গান বেশ উপভোগ করে যুবরা।
এসময় সবাই মমতাজের সাথে কণ্ঠ মেলান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও এ সময় উচ্ছ্বসিত দেখা যায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই যুবলীগের প্রতিষ্ঠা থেকে বর্তমানের ক্রমধারা বর্ণনা ও তার সাথে নৃত্যানুষ্ঠান ছিল অসাধারণ। মিছিলে মিছিলে ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্যানে মিলিত হওয়া নেতাকর্মীদের পাশাপাশি যুবসমাজের আনন্দঘন এই আয়োজনে আনন্দের অংশীদার হতে যোগ দিয়েছেন হালের সেরা চিত্রনায়কদের অন্যতম রিয়াজ ও ফেরদৌস।
সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি আবারও ক্ষমতায় এলে দলটির নেতাকর্মীরা বিদেশি ঋণ, গণতন্ত্র এমনকি সুযোগ পেলে বাংলাদেশকেও গিলে খাবে।’ নেতাকর্মীদের সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যুবলীগ কথা রেখেছে। যুবলীগের সম্মেলন জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছে।’
বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, খেলা হবে...খেলা হবে! দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, খেলা হবে বিএনপির বিরুদ্ধে, আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, খেলা হবে ভুয়া ভোটার তালিকার প্রণয়নকারীদের বিরুদ্ধে।’ সমাবেশে যুবলীগের নেতাকর্মীদের কাছে তিনটি দাবি জানিয়েছেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শাসম পরশ।
তিনি বলেন, ‘এই মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আমি আমার যুবলীগের সহকর্মীদের কাছে তিনটি দাবি রাখতে চাই। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে, ভাই-ভাইয়ের সাথে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করে, নিঃশর্তভাবে ঐক্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি— আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সব সহযোগী সংগঠনের মধ্যে যদি ঐক্য-সমন্বয় থাকে, তাহলে কোনো যুদ্ধপরাধী, রাজাকার, আল বদরের বংশধররা বাংলাদেশের মুক্তিযদ্ধের পক্ষের শক্তিকে পরাজিত করতে পারবে না। আরেকটি দাবি রাখতে চাই, যে উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের এ দেশকে দিয়েছেন, সেই অর্জনগুলোকে জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হবে। জনসংযোগ বাড়াতে হবে এবং মানুষকে জ্ঞাত করতে হবে। বিএনপি প্রপাগান্ডার রাজনীতি করে।
এ প্রপাগান্ডা আমাদের খণ্ডন করতে হবে। বিএনপির মিথ্যাকে আমাদের সত্য দিয়ে ঢাকতে হবে এবং এই সত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিএনপিকে আমরা পরাজিত করব’, বলেন তিনি।
শেষ দাবিতে তিনি বলেন, ‘প্রায় ১৪ বছর আমরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আছি। আর ১৪ মাস ক্ষমতায় আছি। অনেক নিশ্চিন্তে আমরা ঘুমিয়েছিলাম। অনেক শান্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের রেখেছেন। আগামী ১৪ মাস বিনিদ্র রাত কাটিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আনতে হবে। চলেন এ ১৪ মাস আমরা পরিবার-বন্ধু ভুলে গিয়ে শুধু দুটি কথা মাথায় রাখি; বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মার্কা নৌকা মার্কা। ১৪ মাস পর যে বিজয় আমরা অর্জন করব, তারপর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দাঁড়াতে পারবে না।’
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে প্রবেশের কিছু আগেই ৬০ হাজার নেতাকর্মী নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ??‘সম্রাট জুমার নামাজের পর প্রধানমন্ত্রী সমাবেশে আসার আগেই মন্দির গেট দিয়ে প্রবেশ করেন। তিনি যুবলীগ দক্ষিণের নেতাকর্মীদের সাথে অবস্থা করছেন।’
দক্ষিণ যুবলীগের এক নেতা বলেন, ‘সম্রাট ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ৬০ হাজার নেতাকর্মী সমাবেশে এসেছি। এ ছাড়া প্রাণের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে যোগ দিতে মারা গেছেন জিন্নাত আলী হারুন নামের এক নেতা। তিনি রাজশাহীর মোহনপুর থানার বাকশীমইল ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। জানা গেছে, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে গরমে অসুস্থ হয়ে পড়লে সহকর্মীরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।