বিদ্যুতে চলমান সংকটেও বকেয়া বিল আদায় করতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। অতীতে এত বড় সংকটে আর পড়েনি জরুরি এই খাতটি। এক দিকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ঘাটতি দিচ্ছে খাতটি, অন্যদিকে গ্রাহকের কাছে বকেয়া বিল পড়ে আছে কোটি টাকা। অঙ্কে সব চেয়ে বেশি বকেয়া বিল জমেছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি গ্রাহক পর্যায়েও বিশাল অঙ্কের বিল পড়ে আছে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কাছে বিদ্যুৎ বিভাগের পাওনা এক হাজার ৮৯৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে পাওনা ৯০৫ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে ৩৯৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থা নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করায় বিপুল অঙ্কের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। তবে তদারকি জোরদার করে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করায় গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ বিলের বকেয়ার পরিমাণ কমানো সম্ভব হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে ৮৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, জননিরাপত্তা বিভাগের কাছে ৬৪ কোটি ২২ লাখ, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে ৬৩ কোটি ৬১ লাখ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের কাছে ৪৩ কোটি ৫৬ লাখ এবং স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ৩৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা পাওনা বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের। এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া আদায়ে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া কমানোর জন্য পর্যায়ক্রমে সব গ্রাহককে প্রিপেইড-স্মার্ট মিটারের আওতায় আনা হচ্ছে।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫১ লাখ সাত হাজার ৪৫২টি প্রি-পেইড-স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে আরও ২০ লাখ প্রি-পেইড-স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হবে। এদিকে ভর্তুকি দায়ে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মূল্য সমন্বয় করা না হলে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের জন্য আসন্ন অর্থবছরে ৩৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। যা চলতি বছরের চেয়ে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সামগ্রিক অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখতে ভর্তুকির প্রয়োজন আছে। তবে বকেয়া এভাবে পড়ে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয়। বিদ্যুৎ খাতের অব্যস্থাপনার আরেক নজির বিদ্যুতে বকেয়া। তারা বলেন, আমাদের দেশের আর্থসামাজিক দিক বিবেচনায় অল্পস্বল্প বকেয়া থাকতে পারে। কিন্তু কোটি কোটি টাকা বকেয়া থাকলে একটি প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।
এদিকে বিধি থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা কার্যকর নেই বিদ্যুতের বকেয়া আদায়ে। বিদ্যুৎ আইন-২০১৮ এর ৭ নং আইনে (অষ্টম অধ্যায়) বলা আছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন, দলিল বা চুক্তিতে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন কোনো গ্রাহকের নিকট বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য মূল্য বা অন্য কোনো অর্থ বকেয়া থাকিলে উহা Public Demands Recovery Act, 1913 (Bengal Act, No. III of 1913))-এর বিধান অনুসারে সরকারি পাওনা হিসাবে আদায় করা যাইবে।
এছাড়া অবৈধ সংযোগ ও বকেয়া বিলের দরুন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিধান রয়েছে।
বিধিতে বলা হয়েছে, ১. কোনো গ্রাহক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে ব্যর্থ হইলে অথবা কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করিলে, লাইসেন্সি নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক ওই গ্রাহক বা ব্যক্তির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করিতে পারিবে।
২. উপ-ধারা-১-এর অধীন কোনো গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হইলে কোনো আদালত লাইসেন্সিকে ওই গ্রাহকের বিদ্যুৎ পুনঃসংযোগ করিবার জন্য আদেশ দিতে পারিবে না।
৩. বিদ্যুৎ বিল প্রণয়ন ও আদায়ের সহিত সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলার কারণে কোনো বিল অনাদায়ী থাকিলে উহার দায় সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ কর্মচারীর ওপর বর্তাইবে। ২০২১ সালের মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিভাগের পাওনা রয়েছে আট হাজার ৫৫৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
এরমধ্যে বেসরকারি খাতে ছয় হাজার ৯৬২ কোটি ৭৪ লাখ, আর সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কাছে বিদ্যুৎ বিভাগের ৭৪৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা পাওনা। ২০০৯-১০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ২৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের আদায়ে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে জানান নসরুল হামিদ। এর মধ্যে আছে, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে (এপিএ) বছর ভিত্তিক বকেয়া হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তদারকিকরণ, বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক মাসিক সমন্বয় সভায় বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া আদায় কার্যক্রম নিয়মিত তদারকি, সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে বকেয়া পাওনা আদায়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠান, বকেয়া আদায়ে বিভাগীয় কমিশনারদের সহযোগিতা গ্রহণ, জেলা পর্যায়ে মাসিক সমন্বয় সভায় বিদ্যুতের বকেয়া বিল পরিশোধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, বিল খেলাপি গ্রাহকদের তালিকা প্রণয়নপূর্বক তা আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রয়োজনে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ।
এক আগে এক প্রতিবেদনে জানা জায়, সরকারি ৫৪ প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া এক হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পৌনে দুই হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৬৯ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। গত বছরের নভেম্বরে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫১৭ কোটি টাকা।
সরকার ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বন্দ্ব বিরাজমান : এদিকে বকেয়া নিয়ে সরকার ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বন্দ্ব বিরাজমান। সরকারের কাছে পাওনা ১৬ হাজার কোটি টাকা রয়েছে বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের। বকেয়া বিল নিয়ে সরকার ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের স্থবিরাবস্থা বিরাজ করছে। চলমান বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই জনসাধারণের ভোগান্তি অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে সেই স্থবিরাবস্থা যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকরা বলছেন, বকেয়া না পাওয়ায় তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আমদানি করতে পারছেন না।
চলমান সমস্যার কথা স্বীকার করে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। আমরা মে মাস থেকে বকেয়া পরিশোধের চেষ্টা করছি, যাতে কেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করতে পারে। ভারী জ্বালানি তেলে চালিত বেসরকারি কেন্দ্রগুলো তিন হাজার ৭২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, এ মাসে তাদের উৎপাদন প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট কমেছে।
বিদ্যুতের বকেয়া আদায়ে ২০ সহস্রাধিক মামলা : বিদ্যুতের বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় গ্রাহকদের বিরুদ্ধে এখন মোট ২১ হাজার ৮৩৮টি মামলা চলছে। ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি এই মামলাগুলো করেছে। এসব মামলার বিপরীতে মোট বকেয়ার পরিমাণ ৫৯৪ কোটি ১৬ লাখ ৬৫ হাজার ১০০ টাকা। সূত্রে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। তাদের করা চলমান মামলার সংখ্যা ৯ হাজার ৮৪৫টি। এসব মামলার বিপরীতে বকেয়ার পরিমাণ ৫২ কোটি ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ২৫৪ টাকা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের করা মামলা আছে চার হাজার ৪৬৬টি। তাদের পাওনা ৫৮ কোটি ২৭ লাখ ৫৪ হাজার ১৩৪ টাকা।
পিডিবির বকেয়ায় বন্ধ ৮০০ মেগাওয়াট উৎপাদন : সরকারের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের পাওনা দুই বিলিয়ন ডলার। গত পাঁচ মাস ধরে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের বিল পরিশোধ করেনি সরকার। বিপিডিবির নথি থেকে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে সরকারের মোট ব্যয় ৭১ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৪ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য ব্যয় করা হয়।
বিপিডিবির সদস্য (অর্থ) শেখ আকতার হোসেন বলেন, ‘চলতি বছরের মে মাসের পর বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের কোনো বিল দেয়া হয়নি। সরকার অর্থ পরিশোধের চেষ্টা করছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বিপিডিবি ব্যবস্থা নেবে।
সূত্রমতে, এখন স্থগিত থাকা ৮০০ মেগাওয়াটের মধ্যে এনার্জিপ্যাকের ২৩০ মেগাওয়াট, হোসাফের ১১৩ মেগাওয়াট, রায় লঙ্কার ২০০ মেগাওয়াট, দেশ এনার্জির ২০০ মেগাওয়াট এবং এনা পাওয়ারের ৫০ মেগাওয়াট।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে জ্বালানি সংকট উত্তরণের জন্য ভর্তুকির প্রয়োজন রয়েছে। দেশে বিদ্যুৎ চুরি ও বকেয়া বিল বন্ধ করতে হবে। এ চুরি বন্ধ করা গেলে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনতে হতো না। জ্বালানির খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনে নেতৃত্বের ব্যর্থতা রয়েছে। আমরা এখনো কয়লা ও গ্যাস অনুসন্ধানে অনেক পিছিয়ে আছি। সরকার জ্বালানি সংগ্রহে যতটা তৎপর জ্বালানি সাশ্রয়ে তেমন নয়।