শ্রমিক ছাঁটাই আতঙ্ক

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২২, ০১:০০ এএম
শ্রমিক ছাঁটাই আতঙ্ক

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে পুরো বিশ্ব। এর আগে করোনা অভিঘাতে স্থবির হয়ে পড়ে অর্থব্যবস্থা। এর প্রভাব পড়েছে দেশেও। এদিকে দেশে ডলার সংকটে এলসি বন্ধ থাকায় ঊর্ধ্বমূল্যের জ্বালানি আমদানি করাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঝুঁকিতে পড়ে শিল্পোৎপাদন খাত। বিদ্যুতে লোডশেডিং, গ্যাস সংকটসহ নানা অসুবিধায় পোশাক শিল্পে উৎপাদন কমেছে অর্ধেকের বেশি। বন্ধ হয়ে হয়েছে শত শত কারখানা। ছাঁটাই হয়েছে হাজার হাজার কর্মী। আবার অনেকে আছেন চাকরি হারানোর শঙ্কায়।

কারখানার মালিকরা বলছেন, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুতের সীমাহীন ঘাটতির ফলে উৎপাদন কমেছে ৫০-৬০ শতাংশ। তারা বলছেন, আগের মতো অর্ডার পাওয়া যায় না। এমনকি প্রাপ্ত অর্ডারও সময়মতো ডেলিভারি দেয়া যাচ্ছে না। নিয়মিত বেতন-ভাতা না দিতে পারায় অনেক কর্মী চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। আবার কোথাও উৎপাদন কমে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক ছাঁটাইও করা হয়েছে। 

এদিকে মালিকদের দাবি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায়  গার্মেন্টস শিল্প, টেক্সটাইল, ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পাট ও পাটজাত পণ্যের কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। দৈনিক কর্মঘণ্টার অর্ধেক সময় শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতন গুনতে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের তথ্য মতে, কারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় কর্মরত এক থেকে দেড় কোটি কর্মী চাকরি হারাতে পারে। বেকার হয়ে পড়বে দেশের শ্রমিকদের বড় একটি অংশ। ফলে কয়েক কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাঁটাইয়ে অভিযোগে কর্মীরা সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। 

আমার সংবাদের সাথে কথা হয় পোশাক সাপ্লাইয়ার শহীদুল ইসলাম সোহেলের সাথে। তিনি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার অন্তত ২০টি তৈরি পোশাক শিল্পকারখানার সাথে কাজ করছেন।

তিনি আমার সংবাদকে জানান, বর্তমানে এই সেক্টরটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। লোকাল এলসি মাধ্যমে আমারা পণ্য রপ্তানি করে থাকি। ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়ায় আমারা সময়মতো বিল পাচ্ছি না। তৈরি পোশাক খাতে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, খুলনা জেলায় বিপুল কারখানা গড়ে ওঠে। স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে। লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে হাজারো প্রতিষ্ঠানের। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান। শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গ্রাস-বিদ্যুতের অভাবে ২৪ ঘণ্টার বদলে অনেক কারখানায় ১০ ঘণ্টা কোনো কোনো কারখানায় ১২ ঘণ্টা উৎপাদন বন্ধ থাকছে। কিছু কারখানা দিনের বেশির ভাগ সময় জেনারেটর দিকে উৎপাদন চালু রাখলেও ডিজেলের দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদনে দ্বিগুণ খরচ হয়ে থাকে। শ্রমিকরা বলছেন, হঠাৎ করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

শিল্পকারখানার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এভাবে চলতে থাকলে অর্ধেক শ্রমিক ছাঁটাই করে কারখানা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হবে। উদ্যোক্তারা বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পের নিটওয়্যার খাতের উৎপাদন ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে গেছে। সঙ্কট কাটানো না গেলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সরকারের সহযোগিতা চান উদ্যোক্তারা। 

এদিকে যশোরের অভয়নগর উপজেলার আকিজ জুট মিলের ছয় হাজার ৩০০ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। বৈদেশিক অর্ডার না থাকায় এবং দেশের বাজারে পাটের দাম বাড়ার কারণে কারখানা সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে কর্মীদের কাজে আসতে নিষেধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আকিজ জুট মিলস দেশে বেসরকারি খাতে পরিচালিত বৃহৎ জুট মিল। এ জুট মিলে তিন শিফটে যশোর, খুলনা ও নড়াইল জেলার বিভিন্ন উপজেলার সাত হাজার শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে। প্রতিদিন তাদের ২৩টি বাসে কারখানায় আনা-নেয়া করা হয়। গত ১৫ নভেম্বর থেকে আকস্মিকভাবে বাস সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে মিল কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কর্তৃপক্ষ স্থায়ী ৭০০ শ্রমিক বাদে সবাইকে কাজে আসতে নিষেধ করেছেন।

এ বিষয়ে মিলের সিবিএ সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, অভ্যন্তরীণ বাজারে গুণগত পাট পাওয়া যাচ্ছে না এবং দামও অনেক বেশি। যে কারণে উৎপাদন সীমিত করেছে কর্তৃপক্ষ। মিলে প্রায় ছয় হাজার ৩০০ বদলি শ্রমিক রয়েছে। মূলত তাদেরই কাজে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। বাকি ৭০০ স্থায়ী কর্মী দিয়ে মিলের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তা ছাড়া বৈদেশিক অর্ডারও কমে গেছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিলের নির্বাহী পরিচালক শেখ আব্দুল হাকিম বলেন, আমাদের পণ্য মূলত তুরস্কে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উৎপাদিত পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না। পাঠাতে গেলে খরচও বেশি হচ্ছে। সেই সঙ্গে নতুন অর্ডারও কমে গেছে। এর পাশাপাশি দেশের বাজারে গুণগত মানের পাট পাওয়া যাচ্ছে না। যে পাট পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম অনেক বেশি। সব মিলিয়ে তিন শিফটে উৎপাদন সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। লোকসান এড়াতে স্থায়ী শ্রমিকদের দিয়ে এখন দুটি শিফটে কাজ চলছে।

সমপ্রতি বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, গাজীপুর ও নরসিংদীর শিল্পাঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটের কারণে ৬০ শতাংশ বস্ত্রকল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দ্রুত সঙ্কট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা না হলে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। চাকরি হারাবেন শ্রমিকরা। ব্যাংকও তাদের পুঁজি হারাবে। প্রয়োজনে বেশি দামে গ্যাস-বিদ্যুৎ কিনব। বেশি দামে গ্যাস-বিদ্যুৎ কিনতে চাইলেও সরকার সেটিও দিতে পারছে না।

একদিকে বৈশ্বিক সঙ্কট অন্যদিকে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কিনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এদিকে ঢাকার ধামরাইয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের প্রতিবাদে শ্রমিকরা পোশাক কারখানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। গত ১৫ নভেম্বর উপজেলার জয়পুরা এলাকার মমো ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার প্রায় এক হাজার শ্রমিক বিক্ষাভ করেন এবং বন্ধ কারখানা খুলে দেয়ার দাবি জানান।

শ্রমিকরা জানান, কারখানাটি পরিচালনায় শ্রম আইন অনুসরণ করা হয় না। যেমন শ্রমিকদের ছুটির টাকা,  মাতৃত্বকালীন ছুটির টাকা দেয়া হয় না, কারণ ছাড়াই শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়, শ্রমিকদের মারধর ও তাদের বেতন দেরিতে দেয়া হয়। এসবের প্রতিবাদে সোমবার শ্রমিকরা কারখানায় কর্মবিরতি পালন করেন। কর্মবিরতি চলাকালে মালিকপক্ষ অশ্বাস দেয় কারখানা সঠিক নিয়মে পরিচালনা করা হবে। কিন্তু আজ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া মন্দার প্রভাবে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কৌশলে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়ে গেছে। বন্ধ রয়েছে নতুন নিয়োগও। বিশেষ করে ছোট ছোট তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এমন অনেক কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আরো কিছু কারখানা বন্ধের উপক্রম হয়েছে।

এতে বন্দর নগরীরসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তার উপর কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে গভীর সঙ্কটে পড়েছেন। ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হলে শ্রম অসন্তোষ দেখা দিতে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ডলারের জোগান দিতে না পেরে ব্যাংকগুলো আমদানির জন্য এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছে। এতে কলকারখানায় দেখা দিয়েছে কাঁচামালের সঙ্কট। আবার বিশ্ব অর্থনীতিতেও চলছে মন্দা।

এদিকে খুলনা-যশোর অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকল লোকসানের দায়ে দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। ইজারার মাধ্যমে পাটকলগুলো চালু করার চেষ্টা করছে সরকার। গত ছয় মাসে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা অনেকগুলো ক্রয় আদেশ বাতিল করেছেন। নতুন করে আন্তর্জাতিক ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না।

এদিকে, খুলনাঞ্চলের সোনালি, এজাক্সসহ বেসরকারি পাটকলগুলো কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে শিল্পাঞ্চলের বেসরকারি জুট মিলগুলো একের পর এক বন্ধ হওয়া শুরু হয়। পাওনার দাবিতে এ সব পাটকলের শ্রমিক কর্মচারীরা আন্দোলন করে আসছেন। 

ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম রসুল খান বলেন, মিলগুলোর না খাওয়া নির্যাতিত-নিপীড়িত অসহায় শ্রমিকরা তাদের পাওনার দাবিতে দীর্ঘ আট বছর যাবত রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। মিলগুলোর মালিকদের কাছে শ্রমিকদের লাখ লাখ টাকা পাওনা থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকরা না খেয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করছে। এখনো অনেকে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকেধুঁকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। আগামী ১৮ নভেম্বর আমরণ-গণঅনশন, রাজপথ-রেলপথ অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠ নামা হবে।

এদিকে গতকাল ঢাকার আগুলিয়ায় রাইজিংটের ফ্যাশন লিমিটেড কারখানা কর্তৃপক্ষের নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানি এবং বেআইনিভাবে চাকরিচ্যুত প্রতিবাদ ও তাদের পুনর্বহালের দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকরা মানববন্ধন করেছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃত্বে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

এদিকে নাটরের সিংড়ার চলনবিলে অবৈধভাবে গড়ে তোলা সিসা তৈরির কারখানা বন্ধ করে দিল প্রশাসন। সম্প্রতি চলনবিলের ডুবন্ত সড়কের সাতপুকুরিয়া ও ডাহিয়ায় মাঝে প্রভাবশালীদের গড়ে তোলা সিসা তৈরির কারখানায় অভিযান চালান সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারখানার কেয়ারটেকার রাজশাহী বেলপুকুরিয়ার আলাউদ্দিনের ছেলে মো. আশিকের (২৭) ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড ও কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

অর্থনীতিবিদ ও গণনীতি বিশ্লেষক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে আমারা চাপের মুখে আছি। কিন্তু যদি চাপ অস্বীকার করে থাকে তাহলে কাঠামোগত সমস্যায় রূপ নেবে।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, জ্বালানি তেলের দাম অযাচিতভাবে বাড়ানো কমানোর কারণে সমস্য সৃষ্টি হচ্ছে।  ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো ও তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই। এভাবে বাংলাদেশে যত সমস্যা আছে, তা আরও বেশি জটিল হয় সমন্বয়হীনতা ও দক্ষতার অভাবে।’