আবারও মামলার ভারে কোণঠাসা বিএনপি। বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে দলটিতে উচ্ছ্বাসের আবহাওয়া বিরাজিত হলেও পুরোনো স্টাইলে মামলা-হামলার দৃশ্যপটে তা অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। গত তিন মাসে শতাধিক মামলায় কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাত ১০ হাজারেরও বেশি। আটক সাড়ে চারশ। নিহত ছয় কর্মী মৃত্যুর প্রতিবাদে কর্মসূচি অব্যাহত। ঝুঁকি নিয়ে মাঠে রয়েছেন তারা। তবে নিহত ও আহত পরিবারের পাশে সহযোগিতায় তৎপর রয়েছে দলটির হাইকমান্ড।
এছাড়া হামলা-মামলায় আহত পরিবারের খোঁজ নিতে বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। বিএনপি দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকলেও সমপ্রতি কিছুটা চাঙ্গা হতে শুরু হলে মামলায় অনেকটা নেতাকর্মীদের মাঝে আবারও আতঙ্ক শুরু হয়েছে। এছাড়া দিনদিন সংঘাতময় হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। এবার আর কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। রাজধানী ছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে এই সংঘাত। দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশগুলোতে করা হচ্ছে হামলা, আবার হামলার পর তাদের নামেই দেয়া হচ্ছে মামলা। বিএনপি-আওয়ামী লীগ ও পুলিশও সংঘর্ষে জড়াচ্ছে বহু স্থানে। রেহাই পাচ্ছেন না দলের সিনিয়র ও কেন্দ্রীয় নেতারাও। নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও করা হচ্ছে হামলা ও ভাঙচুর। এ নিয়ে সম্পদ রক্ষায় আবারও পুরোনো ভয় তৈরি হচ্ছে বিএনপিতে। বিশেষ ক্ষমতা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় মাঠপর্যায়ের নেতাদের মাঝেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২২ আগস্ট থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৯৬টি মামলা দায়ের হয়েছে, চার হাজার ৪১২ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে, ১০ হাজার ৬৬৪ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি, ৪৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হচ্ছে, আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ বাধাগ্রস্ত করার কৌশল হিসেবে ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগরীর উত্তরে পাঁচটি মামলা এবং ৬২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণে নবীউল্লাহ নবীসহ ২৪৫ জনের নামে ১০টি মামলা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা জেলার সাভারে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান সালাউদ্দিন বাবুসহ ৩২ জনের নামে মামলা হয়েছে। কেরানীগঞ্জ মডেল থানায়ও দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে ৬২ জন।
বাড্ডা থানায় ফ্লাট সংক্রান্ত চাঁদাবাজি মামলায় গায়েবিভাবে বিএনপি ও অংঙ্গ সংগঠন নেতাকর্মীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি ইউসুফ বিন কালু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম হাওলাদারসহ ২৪ জনকে আটক করা হয়েছে। মানিকগঞ্জ জেলায় ৬৩ জনের নাম উল্লেখ করে চারটি মামলা দায়ের এবং একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ জেলায় ৬২ জনের নাম উল্লেখ করে দুটি মামলা দায়ের। দলটির সেবাবিষয়ক সম্পাদক ও মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব কামরুজ্জামান রতনকে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে আটক রাখা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ৫০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। নরসিংদী জেলায় ৮৬ জনের নাম উল্লেখ করে চারটি মামলায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতিতে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া দেশব্যাপী হামলার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বিএনপিতে। রাজশাহী বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য রুমানা মাহমুদ এবং বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সম্পাদক সাবেক এমপি পাপিয়াকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নাটোর জেলার গোপালপুরে বিএনপি অফিসে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়ে অফিস ভাঙচুর করে এবং অফিসে বোমা পেতে রেখে বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম মোল্লা, সাইফুল ইসলাম রানাসহ বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে পুলিশ মামলা দায়ের করেন। এছাড়া ফেনী জেলায় ছাত্রদলের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে প্রায় ২০ জন নেতাকর্মীকে আহত করে এবং ইব্রাহিমকে গ্রেপ্তার করে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে। পুলিশের গুলি ও হামলায় ফেনী জেলা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম দুলাল, ফেনী জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক মইনুল পারভেজ, সদর উপজেলা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ইয়াছিন আরাফাত, ফেনী জেলা ছাত্রদলের সদস্য মো. শরিফ, মারুফ। উপজেলা ছাত্রনেতা জাহেদ হাসান রনি, মো. অপু, মো. মনির। পৌর ছাত্রনেতা মোজাম্মেল হোসেন অর্পণ, মো. মুরাদ হোসেন, মারুফ, মামুন, রমজান, রবিন, আরমান গুরুতর আহত হয়েছেন। এছাড়া সিলেট বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর গুলিবর্ষণে প্রায় ৩০ জন আহত এবং ৯টি মামলায় শত শত নেতাকর্মীর নাম রয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমার সংবাদকে বলেন, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে, গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লক্ষে ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ভোলার আব্দুর রহিম, নূরে আলম, নারায়ণগঞ্জের শাওন প্রধান, মুন্সীগঞ্জের শহিদুল ইসলাম শাওন ও ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নয়ন মিয়াকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও আওয়ামী লীগ যশোরে আব্দুল আলিম, বাগেরহাটে নূরে আলম ভূইয়া তনু, নারায়ণগঞ্জে মো. অমিত হাসান, সিলেটে আ ফ ম কামালকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে সরকার বিভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের আগের মতো দমন কৌশল অবলম্বন করছে। হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার, নিজেরাই বোমা পুঁতে রেখে বিরোধী মতের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, নিজেদের অফিস নিজেরাই ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার পুরোনো প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম দেখে সরকার ভয় পেয়ে গেছে। তাই দেশের প্রতিটি থানায় মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। আমি সরকার ও পুলিশ বাহিনীকে বলব আপনাদের সময় শেষ। আপনাদের কথা আর বেশি দিন চলবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, আওয়ামী লীগ পুরোনো কৌশল গ্রহণ করেছে। আমাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন। কিন্তু হামলা-মামলায় ভীত না হয়ে নেতাকর্মীরা আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। এবার কোনো বাধাই আন্দোলনকে দমাতে পারবে না। নেতাকর্মীদের যেকোনো বিপদে অতীতের মতো আগামীতেও দল পাশে থাকবে।