চলছে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’খ্যাত কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২২ এর গ্রুপ পর্বের খেলা। উৎসব ও ফুটবলপ্রিয়, আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতির মধ্যেও এ নিয়ে বিরাজ করছে উৎসাহ-উদ্দীপনা, আনন্দ-উত্তাপ ও উন্মাদনা। তবে দেশের একাধিকস্থানে এই উন্মাদনা ইতোমধ্যেই পরিণত হয়েছে বিষাদে। কোথাও হার্টঅ্যাটাকে মৃত্যু, কোথাও পতাকা ঝোলাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মৃত্যু, কোথাও সমর্থকদের সংঘর্ষ, হানাহানি। ঘটছে হতাহতের ঘটনাও।
এছাড়া ভাইয়ে-ভাইয়ে, বন্ধু-বন্ু্লতে, চাচা-ভাতিজাতে, স্বামী-স্ত্রীতেও ঘটছে রেষারেষি ও হিংসা-বিদ্বেষের ঘটনা। বিশেষ করে পাড়া-মহল্লার অলিগলি কিংবা রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বিভিন্ন ক্লাবে প্রজেক্টরের মাধ্যমে খেলা দেখার সময়ও ঘটছে হাতাহাতি-হানাহানির ঘটনা। এসব হানাহানিতে লিপ্তদের বেশিরভাগই কিশোর।
এর মধ্যেই রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। বিপরীত দলের সমর্থকদের কটাক্ষ করা, অধর্শতাধিক কিংবা তারও বেশি মোটরসাইকেল একসাথে করে সাইল্যান্সারের উচ্চশব্দে বিজয় উল্লাস, আতশবাজি-পটকা ফোটানোসহ বিভিন্ন ধরনের কটূক্তিমূলক স্লোগানেও চলছে কিশোর গ্যাংয়ের উল্লাস। এসবের বিরুদ্ধে কথা বললেও হানাহানিতে জড়াচ্ছে তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ঘটছে অতিমাত্রায় বুলিংয়ের ঘটনা।
সামনাসামনি না হলেও একে অপরের ওপর হয়ে উঠছেন ক্ষিপ্ত ও প্রতিশোধপরায়ণ। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসাথে খেলা দেখা, সিনেমা-নাটক দেখা, একসাথে উৎসব করা— এগুলো বাঙালি জাতির চিরায়ত রীতি, কালচার। সৌহার্দ্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ এগুলো ভালো কালচার। অথচ সামাজিক পরিবর্তনের ফলে এসব ভালো কালচারগুলোকেও এখন খারাপভাবে ব্যবহার করছে মানুষ। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে দিন দিন মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক ইমোশন তৈরি হচ্ছে। একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারছে না, সহমর্মিতা দেখা যায় না, ভ্রাতৃত্ববোধও কমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাটারা থানাধীন জগন্নাথপুর এলাকায় শহীদ আব্দুল অজিজ সড়ক, শহীদ হারেস সড়ক এলাকার অবস্থা ভয়াবহ। যেকোনো সময় ওই এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে। স্থানীয়রা বলছেন, বাইকের সাইল্যান্সারের উচ্চ শব্দ, আতশবাজিসহ বাজে ভাষায় এক দলের সমর্থকরা আরেক দলের সমর্থকদের গালমন্দ করছে। একই পরিবারের দুই ভাই দুই দলের সমর্থক (আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল)। পাশাপাশি দুটি প্রজেক্টর স্থাপন করে খেলা দেখছেন।
ওই এলাকায় পরিস্থিতি এমন যে- দল সমর্থন করা নিয়ে পারিবারিক সম্পর্কেও ফাটল ধরেছে। মিরপুরেও একই অবস্থা। পল্লবীতে রাস্তা অবরোধ করে প্রজেক্টরের মাধ্যমে খেলা দেখতে গিয়ে বসছে মাদকের আসর। প্রকাশ্যে মাদক সেবন, প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের উদ্দেশ করে বুলিংয়ের ঘটনাও ঘটছে। সেখানেও যেকোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। সবুজবাগ থানা এলাকায়ও একই অবস্থা। যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় ইতোমধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ফুটবল একটা খেলা। এটাকে কেন্দ্র করে এখন নেতিবাচক ইমোশন তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা জায়গা আছে, এটিতে জোর দিতে হবে। আরেকটি হচ্ছে- প্রতিটি থানাতেই কমবেশি বিট পুলিশিং বা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যক্রম রয়েছে। বিট পুলিশিংকে এ জায়গায় সচেতন হতে হবে। বিট পুলিশিং বা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের প্রতিটি এলাকায় ফোরাম থাকে। ফোরামগুলো এ সময় বেশি কাজ করা দরকার। যারা ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা অন্য যারা প্রতিনিধি থাকে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে এ জায়গাটা তৈরি করতে হবে। যেকোনো অবস্থায় যেন কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটে। আর যেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে সেখানে সমাজেরও একটা দায় রয়েছে।
তিনি বলেন, খেলাকে কেন্দ্র করে উছ্বাস-উল্লাস ভালো, কিন্তু উছ্বাস-উল্লাসের সাথে যে ধরনের নেতিবাচক ইমোশন তৈরি করছে মানুষ এক্ষেত্রে আমি মনে করি এটা ওই ব্যক্তিরই মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বা নিজস্ব জায়গা থেকে অপরাধ প্রবণতা। সেক্ষেত্রে কমিউনিটি পুলিশের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। বিশ্বকাপের এবারের আসর ঘিরে অতিউৎসাহে কাঁচা বাঁশে আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ হারিয়েছে খাগড়াছড়ির দীপেন ত্রিপুরা ও টাঙ্গাইলের সখীপুরে তানভীর হাসান নামের এক স্কুল ছাত্রসহ আরও একজন। যার শিরোনাম হয়েছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও।
এছাড়া বাড়ির আঙিনা, রাস্তা বা ছাদে বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের অন্ধ সমর্থকদের মধ্যে পতাকা টাঙানো নিয়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে হাতাহাতি, মারামারি। এমনকি ছুরিকাঘাতে হতাহতসহ ঘটছে নানা ঘটনা। যেখানে বিশ্বকাপ ফুটবলে এখনো খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। যে কারণে বিশ্বের অন্যান্য দল কিংবা খেলোয়াড়দের সমর্থন জানাচ্ছে ফুটবলপ্রেমীরা। কিন্তু প্রিয় দলের খেলা নিয়ে মারামারি, হানাহানি বা অতিরিক্ত বাড়াবাড়িই- এখন ঘটাচ্ছে নানা বিপত্তি।
গত বিশ্বকাপেও বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে সাপোর্টের নামে মারামারি-খুনাখুনিসহ বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। ঘটেছে ভাই-ভাইয়ে, বন্ধু-বন্ধুয়ে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি, মারামারি, রেষারেষির মতো ঘটনাও।
সামাজিক পরিবর্তনের ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কথা উল্লেখ করে অপরাধ বিজ্ঞানীরা আরও বলছেন, এসব ঘটনারোধে বিশ্বকাপ ফুটবল উত্তাপ ও উন্মাদনায় বেসামাল না হয়ে, শান্ত-সুন্দর মনমানসিকতাকে মাথায় রেখে ছোটবড় ভেদাভেদ, রেষারেষি, মারামারি, একে অপরের প্রতি কটূক্তি, বিভিন্ন ধরনের উসকানি বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই।
জানা গেছে, গোপালগঞ্জে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন পাঁচ ব্রাজিল সমর্থক। আর্জেন্টিনা ও সৌদি আরব ম্যাচের পর এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আর্জেন্টিনা-সৌদি আরবের খেলা শেষে গোপালগঞ্জ সদরের নবীনবাগ মার্কাস মহল্লায় সন্ধ্যায় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সমর্থকদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে আর্জেন্টিনা সমর্থকদের হামলায় ব্রাজিলের পাঁচ সমর্থক আহত হয়। গোপালগঞ্জ সদর থানা পুলিশ জানায়, এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি। একইভাবে প্রজেক্টর বসানোকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার নাটোরের গুরুদাসপুরের মিল্কি বাজারেও দুই গ্রুপের সংঘর্ষে উভয়পক্ষের ছয়জন আহতের ঘটনা ঘটেছে। উভয়পক্ষই আর্জেন্টিনা সমর্থক।
জানা যায়, মিল্কি বাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে চাপিলা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সামসুল হকের ভাই, ভাতিজা ও তার সমর্থকরা তাদের নিজস্ব জায়গার ওপর প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখে আসছে। অপরদিকে বাজারের উত্তর পার্শ্বে একই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রাজ্জাক আলীর ছেলে সাইফুল ইসলাম, সামাদ হোসেন ও তার সমর্থকরা প্রজেক্টরের মাধ্যমে খেলা দেখছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সামসুল হক বাজারে চা খেতে গেলে তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন সামাদ ও সাইফুল। দ্বন্দ্বের একপর্যায়ে সামসুল হকের প্রজেক্টরে খেলা পরিচালনা করতে নিষেধ করে সামাদ। তর্কবিতর্ক করতে করতে দুই পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই উভয়পক্ষের ছয়জন গুরুতর আহত হন। গুরুদাসপুর থানার ওসি আব্দুল মতিন জানান, এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
সবশেষ সোমবার সন্ধ্যায় চাঁদপুর সদর উপজেলায় খেলা নিয়ে বিতর্কের একপর্যায়ে বন্ধুর ছুরিকাঘাতে নিহত হয় মেহেদী হাসান। ছুরিকাঘাত করা বরকতকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। জানতে চাইলে ওসি আব্দুর রশিদ বলেন, খেলা নিয়ে নয়, কোমড়ের বেল্ট নিয়ে ঝগড়ার একপর্যায়ে বরকতের ছুরিকাঘাতে মারা যায় মেহেদী।
কুমিল্লার বুড়িচং থানার ওসি মারুফ রহমান জানান, গত মঙ্গলবার নিমসায় আর্জেন্টিনার পরাজয়ে শিকারপুর গ্রামে হার্ট অ্যাটাকে কাউসার জাভেদ কাকন নামে এক সমর্থকের মৃত্যু হয়েছে। প্রিয়দল আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি কাউসার জাভেদ। কাতার বিশ্বকাপে গ্রুপ সির ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারিয়েছে সৌদি আরব। এতেই হার্ট অ্যাটাক করেন তিনি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মনজুর রহমান বলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতেই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশের সব ইউনিটকে নির্দেশনা দেয়া আছে। শুধু ফুটবল বিশ্বকাপের সময়ই নয়, সবসময়ই এ নির্দেশনা বহাল থাকে। যেখানেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটবে কিংবা অবনতির শঙ্কা দেখা দিবে সেখানেই পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।