২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে বিরোধী দলগুলোও তৎপর হচ্ছে। করছে সভা-সমাবেশ। মিছিল-সমাবেশে আসা নেতাকর্মীরা প্রতিপক্ষের সাথে জড়িয়ে পড়ছে সংঘর্ষে। বাড়ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা ও সংঘর্ষে জড়ানোর ঘটনাও। স্থানীয় নির্বাচন ঘিরেও ঘটেছে সহিংসতার ঘটনা। এতে প্রাণহানি ঘটছে। গত ৯ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৩৮৭টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮ জন। আহত হয়েছেন অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সহিংসতার তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য জানিয়ে আইন ও সালিশকেন্দ্র-আসক। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আলোচিত সময়ের মধ্যে (৯ মাস) সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লায়। কুমিল্লায় ২৫টি সহিংসতার ঘটনায় দুজন নিহত ও ২৫৬ জন আহত হয়েছেন। এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম। এ জেলায় ২৩টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এতে ছয়জন নিহত ও ৩০২ জন আহত হন।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, শুধু সেপ্টেম্বরেই দেশে ৫০টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে একটি সহিংসতার ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৯০১ জন। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ২৮ জন, যারা সবাই গুরুতর আহত হন। এরই মধ্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু বিএনপির ‘ডেডলাইন ১০ ডিসেম্বর’।
এদিনকে ঘিরে জনমনে নানা প্রশ্ন। বিএনপির বক্তব্যে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারাও। হঠকারি কোনো কর্মসূচি করা থেকে বিরত না থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বসে থাকবে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে অনড় বিএনপিও। তারা ঢাকার রাজপথ দখলের বার্তা দিচ্ছে সভা-সমাবেশে। ফলে প্রশ্ন একটাই— কী হতে চলেছে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হওয়া ১০ ডিসেম্বরে? আর এ নিয়ে যতই দিন গড়াচ্ছে ততই বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
বিএনপির তর্জন-গর্জন, আওয়ামী লীগ-যুবলীগের পাল্টা হুঁশিয়ারি— দুপক্ষের এমন বিপরীতমুখী অবস্থানে ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে ১০ ডিসেম্বর ঘিরে সর্বোচ্চ সতর্ক পুলিশ, র্যাব সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। তৎপরতা বাড়াচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও।
ইতোমধ্যেই এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে কয়েক দফা। আন্দোলন-সংগ্রাম বা গণসমাবেশের নামে রাজনৈতিক কোনো দল সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও গাড়িতে আগুন দিলে কঠোর অবস্থানে যাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে দেশজুড়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে সংস্থাগুলো। বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীর নিরাপত্তা জোরদারে ইতোমধ্যে ডিসেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহ ডিএমপি সব বিভাগের সদস্যদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
ডিএমপি কমিশনার মৌখিকভাবে সব বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। ১৭ ডিসেম্বর থেকে পুলিশ সদস্যরা ফের নিয়মিত ছুটি কাটাতে পারবেন। তবে মৃত্যু সংবাদ ও অসুস্থতাসহ পারিবারিক সংকট এই আদেশের আওতার বাইরে থাকবে।
ডিএমপির সদর দপ্তর সূত্র জানায়, আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত কোনো হুমকি নেই। তবে সমাবেশে ঢাকার বাইরে থেকে অসংখ্য মানুষ আসবে, তখন অপরাধীরা সুযোগ নিতে পারে। এ সময় সড়ক, বাড়ি, মার্কেট, ব্যাংক ও বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। এ জন্য ডিএমপির নিজস্ব ফোর্স, সব বিভাগের সদস্যদের কর্মস্থলে থাকতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে বাইরে থেকেও ফোর্স আনা হবে।
এছাড়া আগামী ৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সম্মেলন। এই সম্মেলন ঘিরেও বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তাই ডিএমিপর ফোর্সের সংখ্যা যাতে না কমে সেজন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রাজনৈতিক ও জাতীয় অনুষ্ঠান রয়েছে। এ সময় নাগরিকদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সাধারণ ছুটি স্থগিত করা হয়েছে। তবে জরুরি প্রয়োজেন অবশ্যই ছুটি পাবেন। এ বিষয়ে ডিএমিপর বিভাগগুলোকে নিজস্বভাবে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
ডিএমপি সুত্র জানায়, বিএনপির থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। বিশেষ করে যারা আগেও জ্বালাও-পোড়াওয়ে জড়িত থাকার অভিযোগের নাশকতার মামলাভুক্ত তাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে। দ্রুতই তাদের আইনের আওতায় আনা হতে পারে। সব মিলিয়ে ওইদিন সহিংসতা ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে থাকবে পুলিশ।
বিএনপি সূত্র বলছে, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে ‘রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা’ তুলে ধলা হবে। তারেক রহমান যে জাতীয় সরকারের কথা বলেছেন, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে দলটি। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে যে বিভাগীয় গণসমাবেশ শুরু করেছিল বিএনপি, সেটি শেষ হবে ঢাকার কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। ফলে এ গণসমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে দলটি। তবে ওইদিন ঢাকায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চায় বিএনপি। দলটি নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের অনুমতিও চেয়েছে। যদিও ডিএমপি থেকে ২৬টি শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে বিএনপি নয়াপল্টনেই সমাবেশ আয়োজনে অনড়।
বিএনপি নেতারা বলছেন, বিভাগীয় গণসমাবেশের সময় সব গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আমরা বলেছি, এভাবে পরিবহন বন্ধ করা যাবে না। আমাদের সমাবেশে যারা আসবেন, তাদের যেন বাধা না দেয়া হয়। তাদের ওপর যেন কোনো আক্রমণও না করা হয়। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করব।’
এদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের অভিযোগের বিষয়ে ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন বলেন, ‘ডিএমপির পক্ষ থেকে এরকম কাউকে গ্রেপ্তার করিনি। যাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাদের বিরুদ্ধে কোনো গ্রেপ্তার অভিযানও চলছে না। তবে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা আছে, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে, তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজামান খান বলেছেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপি সমাবেশের নামে যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্টের চেষ্টা করে তবে তারা ভুল করবে। আর খালেদা জিয়া যদি সমাবেশে যোগ দেন তাহলে আদালত ব্যবস্থা নেবেন। জঙ্গি হামলা বা নাশকতার কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘আশঙ্কা না থাকলেও আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি। যারা এ ধরনের কাজ (নাশকতা ও জ্বালাও-পোড়াও) করতে পারে তাদের ওপর নজরদারি রাখা হচ্ছে।’ তবে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই ধারণা, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের হুঙ্কারে দলীয় সংঘাতের শঙ্কাও রয়েছে ওইদনি। গত ৩১ অক্টোবর তিনি বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, আপনাদের মোকাবিলায় যেকোনো দিন যেকোনো সময় আমরা প্রস্তুত। এছাড়া ১০ ডিসেম্বর রাজপথ দখলে নেয়ার ঘোষণাও দিয়েছে সংগঠনটি।