- সাক্ষীর অভাবে আটকে আছে শুনানি
- ব্যর্থ হয়ে বারবার সময় চায় রাষ্ট্রপক্ষ
- দায় আছে তদন্ত কর্মকর্তা ও ডাক্তারেরও
- এক মামলায় ২৮৬ বার সময় নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ
- সাক্ষীরা বলেন ডাকে না, রাষ্ট্রপক্ষ বলছে ডাকলে আসে না
- হত্যামামলায় মনিটরিং জরুরি : মত বিশেষজ্ঞদের
মোহাম্মদ হোসেন। ১৯৯৪ সালে লোহাগাড়ার তিনকুনিয়াপাড়ায় ডাকাতের গুলিতে আহত হন। গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তিন দিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে মারা যান মোহাম্মদ।
ওই ঘটনায় তার চাচা সাহেব মিয়া বাদী হয়ে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তদন্ত শেষে এক বছরের মধ্যে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। তবে মামলার বিচারকাজ আর আগায়নি। মামলাটি দীর্ঘদিন ঝুলে আছে। বর্তমানে মামলাটি চট্টগ্রাম বিশেষ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। গত ২০ অক্টোবরও সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ছিল কিন্তু কোনো সাক্ষী আসেনি।
এমনকি মামলা তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ সাক্ষীও হাজির হচ্ছে না। অপরদিকে সমন দিয়েও হাজির করা যায়নি মেডিকেল অফিসার ডাক্তারকে। আদালত থেকে বারবার পুলিশ সুপারের কাছে চিঠি পাঠানো হলেও সাক্ষীরা হাজির হচ্ছে না। হাজির করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষের নানা চেষ্টার পরও সাক্ষীদের বর্তমান অবস্থান শনাক্ত করা যায়নি। কোথায় আছে জানা যায়নি।
জানা গেছে, মামলাটির পাঁচজন সাক্ষীর মধ্যে কেউই আদালতে আসেনি। এতে বিচার কবে শেষ হবে তা নিয়ে নিহত হোসেনের পরিবার হতাশ।
তার ভাই মনজুরুল আলম বলেন, ‘আর কত খবর নেব। বিচার কবে শেষ হবে জানি না।’
শুধু হোসেন হত্যামামলাই নয়, এছাড়াও বেশ কয়েকটি হত্যামামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের অদক্ষতা, সাক্ষী হাজিরে অসহযোগিতার কারণে মামলা ঝুলে থাকে। বিচারপ্রার্থীদের অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় সাক্ষী এলেও তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। আসামিপক্ষের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এমন কাজ করা হয়। আর রাষ্ট্রপক্ষ নিজেও অনেক সময় অযথা সময়ের আবেদন করে। এতে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হয়।
এমনকি সরকারি সাক্ষী (ডাক্তার পুলিশ) হাজির করতে গাফিলতি করেন সরকারি কৌঁসুলিরা। তাদের হাজির না করেই বলেন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মানে দায় এড়ানোর চেষ্টা। আবার শুনানির তারিখ এলেই রাষ্ট্রপক্ষ প্রস্তুত নয় বলে আদালতে আবেদন করা হয়। আদালতও নির্বিকার হয়ে সময় আবেদন মঞ্জুর করেন। ফলে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া ঝুলে যায়। একসময় বিচারপ্রার্থীরা হতাশ হয়ে রায়ের আশা ছেড়ে দেন। বিরক্তি চলে আসে আদালতের প্রতি। এমনই এক গ্যাঁড়াকলে পড়ে ৪৫ বছর ধরে আটকে আছে ঢাবি শিক্ষার্থী বীরেন্দ্র হত্যামামলা।
১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে খুন হয়েছিলেন ভূতত্ত্ব বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র বীরেন্দ্র কুমার। ওই ঘটনায় হত্যামামলা হলেও আসামি কখনো গ্রেপ্তার হয়নি। ৪৫ বছরেও শেষ হয়নি বীরেন্দ্র হত্যার বিচার। আদালত সূত্র ও মামলার নথিপত্র থেকে জানা গেছে, বীরেন্দ্র হত্যাকাণ্ডের পর গত ৪৫ বছরে ওই মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন ৩৪ জন বিচারক। শুনানি হয়েছে ২৬৮ কার্যদিবস।
এরমধ্যে মামলার আট সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনজন। বাদীসহ বাকি পাঁচ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। বছরের পর বছর রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করার জন্য আদালতের কাছে সময় চেয়ে আবেদন করে চলেছে। এ পর্যন্ত ২৮৬ বার সময় নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। সাক্ষী হাজির করতে অন্তত পাঁচবার পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্ট থানায় চিঠি পাঠিয়েছেন আদালত। অনুপস্থিত সাক্ষীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। তবুও হাজির করা যায়নি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব মামলার সাক্ষী আসছে না এবং বারবার সময় চায় রাষ্ট্রপক্ষ, সেগুলোর বেশির ভাগই খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, মাদক, অস্ত্র ও ছিনতাইয়ের মামলা। মারাত্মক অপরাধের এসব মামলায় সহজে কেউ সাক্ষ্য দিতে চান না। আর সাক্ষী না আসায় মামলার শুনানি পেছাতে বারবার সময় নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। কোনো কোনো মামলায় ২০০ থেকে ৩০০ বারও সময় নেয়া হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে।
তবে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলিরা সাক্ষীদের হাজির করতে না পারার পেছনে পুলিশকে দোষারোপ করেন। তারা বলছেন, সাক্ষীদের হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। তারা তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা তাদের বারবার বলতে পারি। কিন্তু এ ছাড়া অন্য কিছু করতে পারি না।
এদিকে গেল বছর ২০২১ সালে আপিল নিষ্পত্তি হওয়া বেশ কয়েকটি হত্যামামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলা দায়ের থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি মামলার চূড়ান্ত বিচারকাজ শেষ করতে গড়ে সময় লেগেছে প্রায় ২৫ বছরেরও অধিক। কোনোটিতে পার হয়েছে দুই যুগও। বিচারিক আদালত দ্রুত রায় দিলেও উচ্চ আদালতে এসে আটকে গেছে। তবে উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো সচলের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
বাদী, আসামি, কৌঁসুলিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফৌজদারি মামলায় প্রতিবেদন দেরিতে আসা, আসামিপক্ষের বারবার সময়ের আবেদন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ, বছরের পর বছর সাক্ষীদের হাজির করতে না পারাসহ নানা কারণে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এতে আদালতের কর্মঘণ্টা ব্যাহত হচ্ছে। বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও বাড়ছে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাদী-বিবাদীরা।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন কোনো আসামির ফাঁসি বহাল রাখে তখন ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাধারণত তিনি রিভিউ পিটিশন দায়ের করেন। সেই রিভিউর শুনানি ও নিষ্পত্তি হতে ছয় মাস থেকে অনেক সময় দেড় থেকে দুই বছর লেগে যায়। বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতায় অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হলেও তা সমাজে অপরাধ দমনে কেমন প্রভাব ফেলে এ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্লুলেস খুনের ঘটনাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে বারবার। অনেক খুনের ঘটনার রহস্য উন্মোচনে দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে গেছে। কোনো কোনো ঘটনায় খুনিরা এতই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ধূর্ত যে খুনের ঘটনা এমনভাবে ঘটানো হয়েছে, আসলেই ক্লুলেস করে রাখা হয়েছে। এসব ক্লুলেস খুনের ঘটনা তদন্তের একপর্যায়ে এসে হাল ছেড়ে দিয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। আবার এমনও হয়েছে যিনি একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা তদন্ত করছেন তার কাঁধে আরও একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে তদন্ত কর্মকর্তা আর কিনারা করতে পারছেন না। মামলার তদন্তের ভাগ্য চলে গেছে ডিপফ্রিজে।
সাক্ষীর বিষয়টি জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, পুরোনো মামলায় যেসব আসামি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন, তাদের মামলার অধিকাংশ সাক্ষী আদালতে আসেন না। সাক্ষীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেয়া হলেও সাক্ষী হাজির করানো হচ্ছে না। এ কারণে বিচারে বিলম্ব হয়। আমরা আদালতের আদেশ পুলিশকে জানাতে পারি কিন্তু সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব তাদেরই।
ফরিদপুর জজকোর্টের আইনজীবী মোসাদ্দেক আহম্মেদ বশির বলেন, বিচারের সাথে দীর্ঘসূত্রতা বেমানান। একজন আসামিকে কেন ১০-১২ বছর কনডেম সেলে থাকতে হবে। আসলে আমাদের দেশে সিস্টেমেই গলদ আছে। এই দীর্ঘসূত্রতায় আসামি ও ভিকটিম দুজনই হয়রানির শিকার হতে পারেন। নিম্ন আদালতে কোনো আসামির ফাঁসি হলে ভিকটিমের স্বজনরা চান দ্রুত ফাঁসি কার্যকর হোক। কিন্তু সব বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সেই দণ্ড কার্যকরে যদি ১৫-২০ বছর চলে যায়, তাহলে বিচারের প্রতি বিচারপ্রার্থীর এক ধরনের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধনী আনা জরুরি। সাক্ষী হাজির করা যাদের দায়িত্ব, তারা যদি আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান ফৌজদারি কার্যবিধিতে সংযোজন করতে হবে। তিনি মনে করেন, সাক্ষী না এলে বিচার করবে কীভাবে? যার জন্য মামলার তারিখ পেছাতে বাধ্য হন আদালত। আর পিপিরাও সময় চান বিভিন্ন কারণে। সাক্ষী হাজির করার জন্য আলাদা সংস্থা গঠন করলে এ সমস্যা আর থাকবে না। কারণ, যারা তদন্ত করেন, তারাই আবার সাক্ষী হাজিরের দায়িত্বে থাকবেন, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।