- প্রশাসনে নানামুখী গুঞ্জন-তিক্ততা
- সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ
- নেতাদের পালটাপালটি হুঙ্কারে আতঙ্ক
- হোটেল, মেস ঢাকার প্রবেশমুখে পুলিশি ভীতি
বিএনপির গণসমাবেশ কোথায় হবে— এ নিয়ে এখনো চলছে রশি টানাটানি। সরকারে থাকা দল আওয়ামী লীগ বলছে, সমাবেশের অনুমতি দেয়া কিংবা কোথায় সমাবেশ হবে— এটা পুলিশের বিষয়। বিএনপিও পুলিশের কাছে সমাবেশের স্থান উল্লেখ করে অনুমতি চাইছে। প্রথম দফায় পুলিশ স্থান নির্ধারণ করে অনুমতি দিলেও সেটি না করে দিয়েছে বিএনপি।
পুনরায় আলোচনায় বসার পর পুলিশ এখন বলছে, টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠ কিংবা পূর্বাচলে সমাবেশ করতে পারবে বিএনপি। কিন্তু এতেও সায় নেই দলটির। বিএনপির চাওয়া তাদের কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে, না হয় আরামবাগের মাঠসহ রাস্তা।
এদিকে সময় যতই গড়াচ্ছে, সমাবেশের স্থান নির্ধারণী জটিলতা, পুলিশ, প্রশাসন, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ততই বাড়ছে অস্থিরতা। অনুমতির বিষয়ে চলমান টানাপড়েন, সমাবেশ ঘিরে নাশকতার আশঙ্কা ঠেকানো, বিএনপির বিভিন্ন মামলায় আসামি থাকা নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার এবং তৎপরতায় অস্থির অবস্থায় দিন পার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
নানামুখী চিন্তাভাবনায় একই ইস্যুতে অস্থিরতার গুঞ্জন দেখা দিয়েছে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়েও। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ছাড়াও সমাবেশ ঘিরে অস্থিরতা বিরাজ করছে দুদলের মধ্যেই। এরসঙ্গে সাধারণ মানুষের অস্থিরতা তো রয়েছেই। যে কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতেই সাধারণ মানুষ পড়ে বহুমুখী সমস্যায়। বিএনপির আসন্ন সমাবেশ ঘিরেও সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যে বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাবনায় উৎকণ্ঠিত। সমাবেশের সময়ও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে সাধারণ মানুষকেই। মোট কথা, বিএনপি ঘোষিত ১০ তারিখের গণসমাবেশ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাশকতার আশঙ্কায় চলমান বিশেষ অভিযানে আতঙ্কিত ও চতুর্মুখী অস্থিরতায় দিন পার করছে সাধারণ মানুষ।
এ ব্যাপারে গতকাল সচিবালয়ে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সরকারের ক্ষমতার পালাবদলের সময় প্রত্যেকবারই সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। দেশের বৃহত্তম দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সব সময়ই একে অপরের প্রতি প্রতিযোগিতার মনোভাব পোষণ করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ইতোমধ্যেই ৯টি বিভাগীয় সমাবেশ শেষ করেছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণসমাবেশ করতে চায় দলটি। এ ইস্যুতে অনড় বিএনপি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও চাইছে এই সমাবেশ যেন কোনোভাবেই পল্টনে বা ঢাকার কোনো রাজপথে করতে না পারে বিএনপি। বিষয়টি নিয়ে গত কদিন ধরেই সচিবালয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে গুঞ্জন চলছে।
দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শ্রমকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আমার সংবাদের কাছে ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, বিএনপির গত রংপুরের বিভাগীয় সমাবেশে তিন দিন পরিবহন ধর্মঘট থাকায় তার অসুস্থ আত্মীয় ঠিক সময়ে ঢাকায় পৌঁছাতে না পারায় বর্তমানে তিনি গুরুতর অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছেন।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলাদলির কারণে হুটহাট করে বাসমালিকরাও যেসব সিদ্ধান্ত নেন, এটি অমানবিক। ১০ ডিসেম্বর নিয়ে তিনি বলেন, সামনে সাধারণ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়বে। যদিও নেতারা ভালোই থাকবেন।
আগামী ১০ ডিসেম্বর নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক অফিস সহকারী জানান, এর আগে বিএনপির সমাবেশের কারণে অনেক দূরের চাকরির পরীক্ষার্থীদের রাজধানীতে ঢুকতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বিএনপির সমাবেশগুলো মূলত শনিবার হয়ে আসছে। আর এর তিন দিন আগে ওইসব বিভাগ থেকে বাসও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। একজন বেকার যুবকের পক্ষে তখন ঢাকায় যাতায়াত ব্যয় তিনগুণ খরচ করতে হয় এবং ওই চাকরির পরীক্ষার্থী মানসিক যন্ত্রণায় থাকেন।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, ভীতির মধ্যে রয়েছি আমরা। যদিও ১০ ডিসেম্বর অফিস নেই। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করার অধিকার আছে। তবে সেখানে জনগণকে জিম্মি করা উচিত হবে না।
তিনি আরও বলেন, ক্ষমতাসীন দল সমাবেশ, মিছিল করলে দলে দলে গাড়ি ঢাকায় ঢুকে যানজটের সৃষ্টি করে। আর এতে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ জনগণ। আবার বিরোধী দল সমাবেশ করলে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়; এতেও সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। তিনি বলেন, দুদিক থেকেই যাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ মানুষ।
একই মন্ত্রণালয়ের আরেক চাকুরে বলেন, বিএনপি ১০ ডিসেম্বর রাস্তায় সমাবশে করতে চেয়ে সবাইকে বিভ্রান্তিমূলক বার্তা দিয়ে সরকারকে ঝামেলায় ফেলতে চায়। তাদের (বিএনপি) রাজনৈতিক সমস্যাটা এখন চরমে। তিনি বলেন, সরকারের উন্নয়ন তাদের সহ্য হয় না। সচিবালয়ে অনেকের মুখেই ১০ ডিসেম্বর নিয়ে ‘খেলা হবে খেলা’ কথাটির ট্রল শুনতে পাওয়া যায়। এছাড়াও অনেককেই অফিসে বসে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে শর্ট ভিডিও (টিকটক) দেখে বিনোদন উপভোগ করতে দেখা যায়।
এদিকে বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছে পুলিশ। গত ১ ডিসেম্বর থেকে আগামী ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সদর দপ্তরের নির্দেশনায় ঢাকাসহ সারা দেশেই চলছে বিশেষ অভিযান। মামলা কিংবা পরোয়ানা ছাড়াও বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছে দলটি। এরমধ্যে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরের আবাসিক হোটেল কিংবা স্ব-স্ব এলাকায় নতুন মুখ দেখলেই ধরপাকড় করছে পুলিশ। এতে সাধারণ মানুষও আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ অভিযানের দিন ঢাকায় এমনও দেখা গেছে, আবাসিক হোটেলে প্রবাসগামী যাত্রীদের ঘুম থেকে তুলে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ তল্লাশি করেছে পুলিশ।
একইভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনদের যারা হোটেলে উঠেছেন, তারাও অভিযানের তোপে পড়েছেন। বাস-সিএনজি অটোসহ সড়কের সর্বত্রই তল্লাশি চলমান রয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে, ঢাকায় বহিরাগত ঠেকাতেও তৎপর রয়েছে পুলিশ। সব মিলিয়ে সমাবেশ ঘিরে পুলিশি অভিযানে সৃষ্ট এমন অস্থিরতায় বিরক্ত প্রকাশ করছেন ভুক্তভোগীরা। প্রয়োজনেও এখন ঢাকায় আসার সাহস পাচ্ছেন না অনেকেই।
রাজনৈতিক ইস্যুতে সৃষ্ট হালের এমন সমস্যায় দুদলের রাজনৈতিক নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে অস্থিরতা কেবলই বাড়ছে। কেউই কাউকে চুল পরিমাণ ছাড় দিতে রাজি নয়। বিএনপিও তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নারাজ। নিজেদের পছন্দের স্থানে সমাবেশ করতে অনড় দলটি। দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারেও চাপে রয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘খেলা হবে খেলা’— এমন বক্তব্যেও ছড়াচ্ছে আতঙ্ক। অতীতের মতো জ্বালাও-পোড়াওয়ের শঙ্কাও বিরাজ করছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তবে দলের হয়ে গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির গণসমাবেশের স্থান নিয়ে সরকারের সঙ্গে দলটির যে দ্বান্দ্বিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা সমাধান হয়ে যাবে।
সমাবেশস্থল নিয়ে এখনো সমঝোতা হয়নি— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হয়ে যাবে। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে মেঘ, ঘন মেঘ ঘনীভূত হয়, আবার চট করে চলেও যায়।’ সরকার কী আরামবাগে অনুমতি দেবে— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যেটাই হোক, একটা সমাধান হবে।’ তিনি আরও বলেন, জনগণের আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই। দলের পক্ষ থেকে আমি বলতে চাই, আমরা সরকারে আছি, কেন দেশের অশান্তি চাইব? আতঙ্ক সৃষ্টি হয়— আমরা এমন কাজ কেন করব? হ্যাঁ, যদি আমাদের ওপর আক্রমণ করা হয়, উসকানি দেয়া হয় এবং আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তো আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না। আশা করছি বিরোধী দল শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করবে। দলীয়ভাবে আমরা তাদের সঙ্গে কখনো সংঘাত সৃষ্টি করিনি। এখন আমরা সংঘাত চাইও না।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে ব্রিটিশ নাগরিকদের চলাচলে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া নির্দেশনায় বলা হয়, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় রাজনৈতিক সমাবেশে সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। সমাবেশের কারণে রাজধানী ঢাকায় যানবাহন চলাচল ও যোগাযোগব্যবস্থা বিঘ্নিত হতে পারে। ওইদিন ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েনও চোখে পড়তে পারে। ‘এ জন্য রাজনৈতিক সমাবেশ ও বড় জনসমাগমের এলাকাসমূহ এড়িয়ে চলতে বাংলাদেশে অবস্থান করা এবং সফররত ব্রিটিশ নাগরিকদের পরামর্শ দেয়া হলো’ বলেও ওই নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়।