নানা আলোচনা, গুঞ্জন, সংঘর্ষ, প্রাণহানির পর পুলিশের অনুমতি নিয়ে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে গতকাল গণসমাবেশ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। একযুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির নেতাকর্মীদের এই সমাবেশ ঘিরে নানা আশঙ্কার কথা সরকার কিংবা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হলেও মূলত দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ব্যতীত বলার মতো তেমন কিছুই ঘটেনি। বরং বিএনপির গতকালের সমাবেশ ঘিরে কেন্দ্রীয় নির্দেশে দিনভর রাজপথের দখল নেয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো। একদিকে চলে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে বিএনপির গণসমাবেশ অন্যদিকে ক্ষমতায় থাকা দলের হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি রান্নার হিড়িক।
এছাড়া ছিল নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান ও টহল। বিএনপির নেতাকর্মীদের অবস্থান গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশস্থলের চারপাশের সড়কে থাকলেও বাকি পুরো ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের অবস্থান ছিল চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন এলাকায় প্যান্ডেল তৈরি করেও সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বসে থাকতে দেখা গেছে। পাশাপাশি মোটরসাইকেল নিয়েও মহড়া দিয়েছেন তারা। পুলিশের পাশাপাশি তল্লাশি করেছে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তল্লাশিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ জনকে ধরে পুলিশেও তুলে দেয় ছাত্রলীগ।
এছাড়া ঢাকার মোড়ে মোড়ে তল্লাশি করা হয় সন্দেহভাজন মানুষদের মোবাইল ফোন, ফোনে থাকা বিভিন্ন সফটওয়্যারও (হোয়াটসঅ্যাপ, ইমু ইত্যাদি)। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দাবি, বিএনপির নাশকতার যেকোনো চেষ্টা প্রতিরোধ করতেই তাদের এই অবস্থান। তবে বিএনপির কর্মীদের অভিযোগ, তাদের সমাবেশে যেতে বাধা দিতেই এই কর্মসূচিতে নেমেছে ক্ষমতাসীন দলটি। বিএনপির সমাবেশের দিন ‘খেলা হবে’ স্লোগানে উত্তেজনার পারদ তোলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১০ ডিসেম্বর নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। সেই নির্দেশনায় গতকাল সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মিছিল বের করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন মোড় ও গলির মুখে তাদের লাঠিসোঁটা নিয়েও অবস্থান নিতে দেখা যায়।
কেন্দ্রীয় নির্দেশনার আলোকে গতকাল ভোর থেকেই রাজপথে বিএনপির নাশকতা ঠেকাতে নেতাকর্মীদের নিয়ে সরব ও সক্রিয় ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন। তিনি মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে দৈনিক বাংলা মোড় থেকে শুরু করে ধানমন্ডি-৩, চাঁনখারপুল, পুরান ঢাকা, ইত্তেফাক মোড়সহ ঢাকা দক্ষিণের ৭৫টি ওয়ার্ডে টহল প্রদান করেন। এরপর দুপুর থেকেই মূলত বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জড়ো হতে থাকেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।
সেখানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সকাল থেকেই বসে ছিলেন। তিনি বলেন, আপনারা জানেন আজ ১০ ডিসেম্বর, বিজয়ের মাস। বিএনপি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে এই মাসের পবিত্রতা নষ্ট করার চেষ্টা করছে। আপনাদের দোয়ায় শেখ হাসিনার সঠিক সিদ্ধান্তে তাদের এই ষড়যন্ত্র ভেস্তে গেছে।
তারা বলেছে, ১০ ডিসেম্বর তারা নাকি ঢাকা শহর দখল করবে। আজ খালেদা জিয়া সরকার দখল করবে। এই পরিকল্পনা নিয়ে তারা সন্ত্রাসী কায়দায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ঢাকাবাসীসহ সারা বাংলাদেশের মানুষ তাদের এই স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে। যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগের শীর্ষ নেতারা বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এলেও ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ শাখা ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়েছিল। কৃষক লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরাও বঙ্গবন্ধু অ্যভিনিউয়ে উপস্থিত ছিলেন।
ফার্মগেটে সকালেই অবস্থান নেয় যুবলীগ উত্তরের নেতাকর্মীরা। যেকোনো ধরনের নাশকতা প্রতিরোধ করতে তারা মাঠে আছেন বলে জানান ওই ইউনিটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাসবিরুল হক অনু। তিনি বলেন, আমাদের নেতা, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে সামস পরশের নির্দেশে সকাল থেকে ফার্মগেট তেজকুনি পাড়া, রাজার বাজার এলাকায় অবস্থান নিয়েছি। কোনো ধরেনর সহিংসতা যাতে বিএনপি-জামায়াত করতে না পারে তার জন্য মাঠে আছি। মিরপুর পল্লবী থেকে শুরু করে ১০ নম্বর গোলচত্বর, সনি সিনেমা হলের সামনে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের লাঠিসোঁটা নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, আমরা দুদিন আগে থেকেই প্রস্তুত আছি। আজ সকাল থেকেই নেতাকর্মীরা রাজপথে আছে, বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে আছে।
ঢাকার প্রবেশ মুখ যাত্রাবাড়ী, শনির আখরা, ধোলাইরপাড়, পোস্তগোলা এলাকায় বিপুল সংখ্যাক নেতাকর্মী নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গেছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কামরুল হাসান রিপনকে। তিনি বলেন, আমাদের স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশে আমরা নেতাকর্মীদের নিয়ে পূর্বাঞ্চল থেকে আসা ও বের হওয়ার প্রবেশ মুখগুলোতে অবস্থান নিয়েছি।
গতকাল বিকেলে যাত্রাবাড়ী মোড, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনির আখড়া, মাতুয়াইল মেডিকেলের সামনে, সাইনবোর্ড, যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়কের কাজলাব্রিজ, ঢাকা-মাওয়া সড়কের দোলাইরপাড়, পোস্তগোলা, শ্যামপুর বাজারে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন। এ সময় তাদের বিক্ষোভ মিছিল করতে দেখা যায়।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বাইক নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গেছে। মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের সামনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মিছিল নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গেছে। মিরপুর কাজিপাড়া, শেওড়াপাড়া ও তালতলা আবাসিক এলাকার অলিগলিতে আওয়ামী লীগ কর্মীরা মিছিল করেন।
মুগদা থানার মান্ডা এলাকার বাসিন্দা ইকবাল জানান, তার এলাকাতেও সরকার সমর্থকরা কিছুক্ষণ পরপর মিছিল আর মহড়া দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ‘আগুন সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে সমাবেশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি মোড়ে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় তাদের অনেকের হাতে রড, লাঠি এবং স্ট্যাম্পও দেখা গেছে। এছাড়া তাদের মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কয়েকটি অটোরিকশা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে ঢুকতে চাইলে তাদের আটকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর কিছুক্ষণ পর সবাই মিলে তাদের কিলঘুষি দিতে থাকে। পরে পাশে থাকা পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়।
মারধরের শিকার ফারুক হোসেন জমাদ্দার নামে একজন বয়স্ক ব্যক্তি বলেন, তিনি ঢাকা উদ্যান এলাকা থেকে যাচ্ছিলেন সমাবেশে যোগ দিতে। নীলক্ষেতের মোড়ে চড়াও হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় তাদের ফোন কেড়ে নেয় তারা। এরপর তাদের কয়েকজনকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। থানায় সোপর্দ করার কথা স্বীকার করলেও মারধর করা হয়নি বলে দাবি করেছেন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রুবেল হোসাইন। তিনি বলেন, কাউকে আমরা আঘাত করিনি। ক্যাম্পাসে নাশকতা করার উদ্দেশ্যে তারা সংঘবদ্ধভাবে আসছিল। এরপর তাদের আটকে আমরা শাহবাগ থানায় সোপর্দ করেছি।
এদিকে বিএনপির সমাবেশস্থলের কাছেই মুগদায় মোটরসাইকেলে মহড়া দিতে এসে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে সেখানে ফ্লাইওভারের নিচে দুটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়া হয়। পুলিশ জানায়, ২০-২৫টি মোটরসাইকেলে ছাত্রলীগের ছেলেরা এসেছিল। পরে সেখানে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে পুড়ে যাওয়া দুটি মোটরসাইকেল পেয়েছি। তবে পথে পথে পুলিশ ও সরকার দলের নেতাকর্মীদের তল্লাশি এড়িয়ে গোলাপবাগে পৌঁছাতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। কৌশলের অংশ হিসেবে তারা ফোন থেকে সব ছবি, তথ্য ডিলিট করে দেন এবং মোবাইলের ডিসপ্লেতে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সমাবেশকেন্দ্রিক, সমাবেশস্থলসহ পুরো ঢাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে র্যাব, আনসার, পুলিশ মোতায়েন করা ছিল। ৩৪ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এ কে এম হাফিজ আক্তার। এর বাইরে র্যাব-আনসারও ছিল বলে জানান তিনি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, বিএনপির সমাবেশ সুন্দরভাবে শেষ করতে দিনভর কাজ করেছে পুলিশ। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল সমাবেশ হয় কি-না বা কোনো বিশৃঙ্খলা হয় কি-না। তবে মানুষ দেখেছে শান্তিপূর্ণভাবেই বিএনপির সমাবেশ শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, কোথাও আইনশৃঙ্খলার কোনো অবনতি হয়নি, সবই স্বাভাবিক ছিল। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করেছে। কোনো আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।