রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের অন্যান্য শহর এবং গ্রামাঞ্চলের বাজার থেকে শুরু করে সবখানেই ফুটপাতে ব্যবসা করছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। এর ফলে জনগণের চলাচলের স্থানে অস্থায়ী দোকানপাট এমনভাবে স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে যে তাদের উচ্ছেদ করতে গেলেও অনেক সময় প্রশাসনকে জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়। সড়কে যানজট দেখা দিলে অনেক সময় মোটরসাইকেল চালক ফুটপাতের পথ ব্যবহার করে থাকে, এতে করে নিরাপদ ফুটপাতও অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে এবং কিছু দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটেছে।
যেখানে নিরাপদে হাঁটার জন্য ফুটপাত তৈরি করা হয়েছে, সেখানে ট্রাফিক নির্দেশনা না মেনে মোটরসাইকেল চালকরা ফুটপাতকে ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে পরিণত করছে। ফুটপাত দখলমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং ফুটপাত দখলমুক্ত করাও হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দখলদাররা সেই ফুটপাত আবার দখল করে নেয়।
রাজধানীতে চলাচলকারী যাত্রী ও পথচারীরা বলছেন, ঢাকা শহরে অধিকাংশ ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় ঠিকমতো হাঁটা-চলা করায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এর মধ্যে ফুটপাতের মাঝ বরাবর যাত্রী ছাউনি স্থাপন শুরু করায় এতে পথচারীদের ভোগান্তি আরও বাড়ছে। সমপ্রতি, রাজধানীর রমনায় ফুটপাতে যাত্রী ছাউনির সামনে রেলিং তোলার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রেলিংটি ভেঙে দেয় কর্তৃপক্ষ।
তবে এমন অপরিকল্পিত আরও কয়েকটি যাত্রী ছাউনি দেখা গেছে। তথ্যমতে, রাজধানীর ফকিরাপুলের কালভার্ট রোডে বাস চলাচল না করলেও তৈরি করা হয়েছে দুটি যাত্রী ছাউনি। বাসাবোর রাস্তার ছাউনিটিও কোনো কাজে আসেনি। এভাবে দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে জনগণের সম্পদ।
ডিএসসিসির প্রকৌশল দপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস রুট রেশনালাইজেশনের অংশ হিসেবে এসব যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হচ্ছে। ফুটপাতে স্থাপন করা এসব যাত্রী ছাউনির সামনে অংশে যাত্রীরা দাঁড়াবেন বা বসবেন। পেছন দিয়ে পথচারীরা চলাচল করবেন। যাত্রীদের সুবিধার জন্যই এ পদ্ধতিতে ছাউনিগুলো স্থাপন করা হচ্ছে। তবে যেসব ফুটপাত চওড়া কম, সেগুলোতে কেন মাঝ বরাবর যাত্রী ছাউনি বসাতে হবে- এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কেউ। বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি সূত্র জানায়, এর চারটি রুটের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) অংশে ২১ নম্বর নতুন ২১টি, ২২ নম্বর রুটে সাতটি, ২৩ নম্বর রুটে ১১টি ও ২৬ নম্বর রুটে সাতটি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেছে ডিএসসিসি।
এর অধিকাংশ যাত্রী ছাউনিই ফুটপাতের মাঝ বরাবর স্থাপন করা হচ্ছে। এতে যারা নগর পরিবহনে ওঠা-নামা করবেন, তাদের সমস্যা হবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত যাত্রী ছাউনিগুলো ফুটপাতের সামনে রেখে করা হয়। কিন্তু নগর পরিবহনের জন্য ফুটপাতের মাঝ বরাবর যাত্রী ছাউনিগুলো স্থাপন করতে বলেছেন মেয়র ও বাস রুট রেশনালাইজেশনের আহ্বায়ক শেখ ফজলে নূর তাপস। ডিএসসিসি এলাকায় ওই যাত্রী ছাউনিগুলো স্থাপনের কাজ করছে সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল দপ্তর।
এ দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব খাদেম বলেন, নগর পরিবহনের যাত্রী সুবিধা নিশ্চিত করতেই যাত্রী ছাউনিগুলো ফুটপাতের মাঝে বসানোর হচ্ছে। এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। অন্যদিকে নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা ও হকারদের কারণে বন্ধ হয়ে আছে ফুটপাত। এগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন কর্মব্যস্ত মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী ও শিশুরা। চলতে গেলেই সব সময় বিপাকে পড়তে হয় তাদের। ফুটপাত আর রাস্তার একাংশ দখল করে, অর্থাৎ হাঁটার অধিকারকে তোয়াক্কা না করে হকারদের ব্যবসা করাটা সবার গা সওয়া হয়ে গেছে। মুখে না বললেও প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকরা কার্যত এটি মেনেও নিয়েছেন। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে কিছুদিন পরপরই ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ অভিযান হয়। পথচারীরা দু-তিন দিন একটু স্বচ্ছন্দে চলাচল করেন। তারপর আবার আস্তে আস্তে আগের অবস্থা ফিরে আসে।
জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ২৯২ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে, উত্তর সিটিতে আছে ২২৩ কিলোমিটার। অভিজাত এলাকার অংশ বাদ দিলে পুরো শহরের অধিকাংশ ফুটপাতের অবস্থাই মোটামুটি একই। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের অবস্থা বেশি খারাপ। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের গুলিস্তান, ফুলবাড়ীয়া, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, জিপিও, মতিঝিল, দিলকুশা, আরামবাগসহ আশপাশের বিরাট এলাকাজুড়ে ফুটপাতের এক ইঞ্চিও খালি নেই। সবই হকারদের দখলে। এই বিশাল দখলদারিত্বকে ঘিরে সক্রিয় চিহ্নিত চাঁদাবাজচক্র। যারা প্রতিদিনই ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তুলছে। প্রতি মাসে এই চাঁদার পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা। যদিও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ঘোষণা ছাড়াই প্রতি সপ্তাহে একদিন অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। সেই ঘোষণার দুই বছর পর অভিযানও চালানো হয়েছে কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন খুব একটা দেখা যায় না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের নিম্ন আয়ের মানুষরাই ফুটপাতে বসে ব্যবসা করে থাকে। প্রথমে ফুটপাত ব্যবসায়ীদের অন্য কোনো স্থানে ব্যবসা করার ব্যবস্থা করে দিয়ে তারপর ফুটপাত দখলমুক্ত করার কাজে হাত দিলে সুফল পাওয়া যাবে এবং ফুটপাত পুরোপুরি দখলমুক্ত হবে, এতে ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।