এই আর্জেন্টিনাকে এবার ঠেকায় কে? কথাটা বলতেই হচ্ছে; লিওনেল মেসিদের যে পারফরম্যান্স তাতে এই কথাটা বললে খুব বেশি ভুল হবে না। ফাইনালে যদি কোনো অঘটন না ঘটে তাহলে হয়তো এবার বিশ্বকাপের ট্রফিটা মেসির হাতেই উঠবে। বিপক্ষ দল যদিও ছেড়ে কথা বলবে না।
তবুও একটা কষ্ট; মেসি খেলবেন এবার শেষ বিশ্বকাপ; তাও আবার ফাইনাল। অবশ্যই তার শেষ বিশ্বকাপের ফাইনালটা রাঙ্গাতে চাইবে মেসি। আরও একবার স্বপ্নের ফাইনালে লিওনেল মেসি। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালেও তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে লড়াই করেছিলেন, কিন্তু দলকে শিরোপা এনে দিতে পারেননি।
জার্মানির কাছে সেই হারে পুড়তে হয়েছে কষ্টের আগুনে। এবার সেই কষ্ট ভুলে যেতে চাইবে মেসিরা। এলএমটেন-এর বয়স এখন ৩৫। আগামী বিশ্বকাপে তার বয়স হবে ৩৯। মেসির জন্য সেই বিশ্বকাপ খেলা কঠিনই হবে। ফর্ম বিবেচনায় তবু অনেকে আশা দেখছিলেন। তবে নিজের অবস্থান এবার পরিষ্কার করে দিলেন সাতবারের ব্যালন ডি’অরজয়ী ফুটবলার।
মঙ্গলবার রাতে ম্যাচ শেষে মিডিয়া বক্সে আর্জেন্টাইন পত্রিকা ‘দারিও ওলেকে’ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মেসি বলেন, পরবর্তী বিশ্বকাপ আসতে অনেক দেরি। আমার মনে হয় আমি সেটি খেলতে পারব না।
ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে ষষ্ঠবারের মতো ফাইনালে উঠেছে আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের শুরুতেই মেসি ঘোষণা দিয়েছিলেন, এটিই তার শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে। আর সেটার শেষ যদি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার মাধ্যমে হয়, সেটি তো সোনায় সোহাগা।
মেসি আরও বলেছেন, অবশ্যই এটা আমার শেষ বিশ্বকাপ। ফাইনাল ম্যাচই আমার শেষ ম্যাচ, এটা ভাবলেও মনের ভেতর শান্তি কাজ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলাম সেটি অর্জন করা থেকে আর এক ধাপ দূরে আমরা। আমরা নিজেদের সেরাটা দিয়েই চেষ্টা করব তা অর্জন করতে। তার ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় এসেও যে জ্বলে উঠেছেন তিনি। মাঠে নামলেই যেন রেকর্ড তাকে হাতছানি দেয়। রেকর্ড যেন তাকে ডেকে বলে, আমাকে ভেঙে দাও। তাইতো নতুন নতুন সব রেকর্ডের জন্ম দেন এলএমটেন। মঙ্গলবার রাতে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও করেছেন নতুন আরও একটি রেকর্ড। এতদিন পর্যন্ত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ গোলের মালিক ছিলেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা।
বিশ্বকাপে তার গোলসংখ্যা ছিল ১০টি। কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে গোল করেই বাতিস্তুতাকে ছুঁয়ে ফেলেছিলেন মেসি। আর সেমিফাইনালে গোল করে সেই রেকর্ড ভেঙে নিজেই এখন দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের মালিক। শুধু তাই নয়; আরও একটি রেকর্ড গড়েছেন তিনি। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে ১০টি ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতার কৃতিত্ব দেখালেন তিনি। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মেসির আগুনে এক পেনাল্টি থেকে গোলের খাতা খোলে আর্জেন্টিনা।
এরপর জুলিয়ান অ্যালভারেজকে দিয়ে মেসি করিয়েছেন দ্বিতীয় গোলটা। মাঝমাঠের কাছে তাকে বলটা ছেড়ে দিয়েছিলেন মেসি, এরপরের কৃতিত্বের পুরোটাই পাওনা ম্যানসিটি ফরোয়ার্ডের। মাঝমাঠ থেকে একা বলটা নিয়ে গিয়ে করেছেন গোলটা, মাঝে দুই ডিফেন্ডারের ছোঁয়া লেগেছে তাতে, তাই মেসির নামে অ্যাসিস্টটা লেখা হয়নি।
তবে তৃতীয় গোলে অবদানের স্বীকৃতিটা মেসি পাবেন ঠিকই। দারুণ এক পিরোয়েট আর শোল্ডার ড্রপে ক্রোয়াট ডিফেন্ডার ইয়োসকো গেভার্দিওলকে ঘোল খাইয়ে, প্রতিপক্ষের আরও দুই ডিফেন্ডারের ফাঁক গলে অ্যালভারেজকে বাড়িয়েছিলেন বলটা, সিটি স্ট্রাইকার গোলটা করেছেন ঠিকই। আর্জেন্টিনাও চলে গেছে বিশ্বকাপের ফাইনালে। এক গোল করে, একটি করিয়ে মেসি বনে গেছেন ম্যাচসেরা।
চলতি বিশ্বকাপে চতুর্থ বারের মতো। এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচসেরা হওয়ার কীর্তিটা তার নিজেরই। ২০১৪ বিশ্বকাপে চারবার ম্যাচসেরা হয়েছিলেন তিনি। সেই রেকর্ডটাই মেসি ছুঁয়ে ফেলেছেন আবার। রেকর্ড আরও একটা হয়েছে, যে রেকর্ড নেই আর কারো। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচসেরা হওয়ার রেকর্ডটা আগেই ছিল তার দখলে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দখলে ছিল সবচেয়ে বেশি ম্যাচসেরা হওয়ার রেকর্ডটা, তিনি সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন সাত ম্যাচে। সেটা মেসি ছুঁয়ে ফেলেন মেক্সিকোর বিপক্ষে গ্রুপপর্বের ম্যাচেই।
এরপর দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও তিনিই হন ম্যাচসেরা, পেছনে ফেলেন রোনালদোকে। মেসি সেখানেই থামেননি। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালেও ম্যাচসেরা হন, হয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালেও। তাতেই গড়া হয়ে গেছে অনন্য নজির।
বিশ্বকাপে ম্যাচসেরা হওয়ার সংখ্যাটা যে দুই অঙ্কে নিয়ে গেছেন তিনি। সাত ম্যাচসেরার পুরস্কার নিয়ে দুইয়ে আছেন রোনালদো। তিনে থাকা আরিয়েন রোবেনের ম্যাচসেরার পুরস্কার ছয়টি। কিলিয়ান এমবাপে, লুকা মদ্রিচ আর লুইস সুয়ারেজের এই কীর্তি আছে পাঁচবার করে। নেইমার, হ্যারি কেইন, এডেন হ্যাজার্ড, মিরোস্লাভ ক্লোসা, কেইসুকে হোন্ডা, হামেস রদ্রিগেজ, ওয়েসলি স্নেইডার, থমাস মুলার, পার্ক জি-সুংদের মতো তারকারা এই পুরস্কার জিতেছেন চারবার করে।