প্রস্তুত আছে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়াম; প্রস্তুত দুই ফাইনালিস্টও। ষষ্ঠবারের মতো ফাইনাল খেলবে আর্জেন্টিনা। আর ফ্রান্স খেলবে চতুর্থবারের মতো। আগামী রোববার রাতে ২২তম ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হবে এ দুই দল।
তবে আর্জেন্টিনা ফাইনালে ওঠার পরপরই উত্তাপ ছড়াতে শুরু করে ফুটবল বিশ্বে। লড়াইটা যে হবে দুই সতীর্থের! তারা দুজনেই খেলেন পিএসজিতে। এবার তারা মাঠে নামবেন একে অপরের বিপক্ষে! ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে প্রতিশোধটা ভালোভাবেই নিয়েছে আলবিসেলেস্তেরা।
গত আসরে যে ক্রোয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা; এবার সেই ৩টি গোলই ফিরিয়ে দিলেন ক্রোয়েটদের। এবার প্রতিশোধের পালা ফ্রান্সের বিপক্ষে। রাশিয়া বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নিয়েছিল মেসিরা। এবার তারই প্রতিশোধ নেয়ার পালা। সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ষষ্ঠবারের মতো ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। দলের সবচেয়ে বড় তরকার বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ এটি।
মেসি চাইবেন তার শেষ ম্যাচটি রাঙাতে। অধরা ট্রফি জিতে কিংবদন্তি হয়েই হয়তো ফুটবলকে বিদায় জানাবেন এলএমটেন। গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচ হেরেই বাদ পড়ায় শঙ্কায় পড়েছিল আর্জেন্টিনা। তবে সেসব শঙ্কা দূর করে আর্জেন্টিনা এখন ফাইনালে। ২০১৪ সালে হূদয় ভেঙেছিল আলবিসেলেস্তেদের। ফাইনালে হেরেছিল জার্মানির কাছে। সেবার ট্রফিতে চুমু আঁকতে পারেননি মেসি। এবার সেই স্বপ্নও কী পূরণ হবে তার?
এদিকে মরক্কোকে হারিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। মরক্কোর বিপক্ষে জয়ের পর ফরাসি তারকা আন্তোয়ান গ্রিজমান বলেছেন, এই বিশ্বকাপে মেসিই সেরা। তবে সতীর্থের এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন ফ্রান্সের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার অরিলিয়েন শোয়ামেনি। রিয়াল মাদ্রিদের তারকা শোয়ামেনির মতে, কিলিয়ান এমবাপ্পে সেরা।
তিনি বলেন, আমি মনে করি কিলিয়ানই সেরা। রোববারে সে সেটা প্রমাণ করবে। শোয়ামেনি আরও বলেন, তারা দুজনই অসাধারণ খেলোয়াড়। খেলাটা তাদের দুজনের হবে না, হবে ২২ ফুটবলারের। তবে আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করব। আমরা পরিকল্পনা সাজাব, পরিশ্রম করব; কারণ খেলাটা মেসিদের বিপক্ষে। ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার মেসি ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে গিয়েছিলেন। সেবার মেসিদের প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি। এবার ফ্রান্সকে হারিয়ে অধরা বিশ্বকাপের ট্রফিটা ধরার সুযোগ মেসির সামনে। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে এই বিশ্বকাপ ট্রফিটাই শুধু নেই মেসির শোকেসে। আর ২৩ বছর বয়সেই দুবার বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ এমবাপ্পের।
দেখা যাক, শেষ হাসিটা কে হাসে— মেসি, নাকি এমবাপ্পে। ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলার ঘোষণাটা দিয়ে রেখেছেন লিওনেল মেসি। ফ্রান্সের বিপক্ষে বিশ্বকাপ ফাইনালটা জিতে অধরা ট্রফিটা হাতে ধরার জন্য একের পর এক চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স দেখিয়ে চলেছেন। দল হিসেবে আর্জেন্টিনাও রয়েছে দারুণ ছন্দে। আলবিসেলেস্তেদের বিপক্ষে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা যে সহজ কাজ হবে না, তা ভালো করেই জানে ফ্রান্স।
ফরাসি ফরোয়ার্ড অ্যান্টনিও গ্রিজম্যান সাবেক ক্লাব সতীর্থ বলেছেন, মেসিকে নিয়ে যে আলাদা পরিকল্পনা করতেই হয়, সেটি আমরা জানি। মেসিকে নিয়ে যে কোনো দলের সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তা-ভাবনা করার ব্যাপারটা থাকে। আমরা এ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সব ম্যাচ দেখেছি। আমরা জানি তারা কীভাবে খেলে। তারা একটি কঠিন দল এবং সেরা ফর্মে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। শুধু মেসি নয়, তার চারপাশের খেলোয়াড়রা সবাই শক্তিশালী। আমরা জানি ফাইনালটা কঠিন ম্যাচ হতে চলেছে। দর্শকদের মধ্যে তাদের অনেক সমর্থন থাকবে।
অন্যদিকে আর্জেন্টিনার ডেরায় উঁকি দিচ্ছে সেই ১৯৭৮ সালের মধুর স্মৃতি। সৌদি আরবের কাছে হার দিয়ে এবারের বিশ্বকাপ শুরু করে আর্জেন্টিনা। গ্রুপপর্বে ফ্রান্স হেরেছে তিউনিসিয়ার কাছে। শেষ পর্যন্ত এ দুটি দলই উঠেছে ফাইনালে।
১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। ৪৪ বছর আগের সেই বিশ্বকাপেও ফাইনালে ওঠার পথে গ্রুপপর্বে একটি ম্যাচ হেরেছিল আর্জেন্টিনা। ফাইনালের অপর দল নেদারল্যান্ডসও হেরেছিল গ্রুপপর্বে।
তবে ১৯৭৮ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা নেদারল্যান্ডস যেমন গ্রুপে নিজেদের শেষ ম্যাচটা হেরেছিল, এবার ফ্রান্সও তেমনি গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচটি হেরেছে। সেই বিশ্বকাপে গ্রুপে নিজেদের শেষ ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-২ গোলে হেরেছিল নেদারল্যান্ডস।
তবে ১৯৭৮ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর্জেন্টিনা। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা দু’দলের সঙ্গে এবারের বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা দু’দলের বেশ মিল রয়েছে। তবে সেবার যেহেতু আর্জেন্টিনা শিরোপা জিতেছিল, তাই সবকিছুর মিল থাকার কারণে এবারও আর্জেন্টাইন সমর্থকরা শিরোপা জয়ে আশাবাদী।
অন্যদিকে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের সঙ্গে এবার মিল রয়েছে ফ্রান্সের। সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল ফ্রান্স। জোড়া গোল করেছিলেন ফ্রান্সের ডিফেন্ডার লিলিয়ান থুরাম। ২০ বছর পর ২০১৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের মুখোমুখি হয় ফ্রান্স। ১-০ গোলের জয়ে উঠে যায় ফাইনালে। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের হয়ে গোলটি করেছিলেন ডিফেন্ডার স্যামুয়েল উমতিতি। সেবারও ফ্রান্সই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
এবারও ঠিক তাই হয়েছে। কাতার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল মরক্কোর বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতেছে ফ্রান্স। ৫ মিনিটে ফ্রান্সকে প্রথম গোলটি এনে দেন ডিফেন্ডার থিও হার্নান্দেজ। আগে যে দুটি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ডিফেন্ডাররা ফ্রান্সকে গোল এনে দিয়েছেন, প্রতিবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ফ্রান্স। এবারও যেহেতু সেমিফাইনালে ডিফেন্ডার গোল করেছেন, ফ্রান্স তাই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশা করতেই পারে।
তবে এসব আশায় ভরসা রাখতে হবে নিজ দায়িত্বে। দু’দলেরই বিশ্বকাপ জয়ের কিছু স্মৃতি এবার মিলে যাচ্ছে কাতার বিশ্বকাপে। কে হবে এবারের চ্যাম্পিয়ন— এমন প্রশ্ন বারবারই ঘুরপাক খাচ্ছে সমর্থকদের মনে। সেটি দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত।