- বিএনপি একা নয়, সব দলকে নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত
- সংবিধান সংস্কার, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা
- অর্থনৈতিক সংস্কার ও প্রশাসনিক কমিশন গঠন
- ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠায় থাকছে ২৭টি বিশেষ অঙ্গীকার
আজ সোমবার রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা ঘোষণা করবে বিএনপি। বেলা ৩টায় রাজধানীর গুলশান-২ এ হোটেল দ্য ওয়েস্টিনে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট জন ও সিনিয়র সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ রূপরেখা ঘোষণা করবেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
আমার সংবাদকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শামসুদ্দিন দিদার। বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখায় কী থাকছে— দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি মনে করে, একা দলটির পক্ষে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা সম্ভব নয়। সে জন্য সরকারবিরোধী দলগুলোর সাথে সমন্বয় করে জাতীয় সরকার গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করাসহ ক্ষমতায় গেলে জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠার ২৭টি বিশেষ অঙ্গীকার রয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারে বেশ কিছু বিষয় ইতোমধ্যে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের আলোচনায় উঠেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার করতে কমিশন গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সংস্কারগুলো হচ্ছে— বিতর্কিত সংশোধনী বাতিলে সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন বাতিল, জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচারে মিডিয়া কমিশন গঠন, সংবিধান মোতাবেক ন্যায়পাল নিয়োগ, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন উল্লেখযোগ্য। পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত বিএনপির সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রস্তাবিত রূপরেখায় ২০১৭ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত ভিশন-২০৩০-কে কেন্দ্রে রেখেই পরিকল্পনা করছে বিএনপি। গত সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই পরিকল্পনার একটি বড় অংশজুড়ে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত পরিবর্তনের প্রসঙ্গগুলো উল্লেখ থাকবে।
এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় সমঝোতা কমিশন গঠন করা। জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সংবিধান সংশোধন করে গণভোটের ব্যবস্থা পুনপ্রবর্তন করা, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বন্ধ করা, বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসবাদের চর্চা বন্ধ করা, বিদ্যুতে আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে আনার বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আমার সংবাদকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অর্থনীতি, শাসন ব্যবস্থাসহ সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে তাতে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে কেউ নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব পায় তাহলেও দেশ চালাতে পারবে না। রাষ্ট্রকে এই ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মেরামতের প্রয়োজন। বিএনপি এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা তৈরি করেছে। এই রূপরেখা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের কিছু প্রস্তাবনা ছিল সেগুলোও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগামীতে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠন করা হবে সেখানে সব দল মিলে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। সেই সরকারই রাষ্ট্র সংস্কার করে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে রূপান্তর করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’
বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখায় যা আছে :
১. ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে সব বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করে এসব রহিত-সংশোধন করা হবে এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সাংবিধানিক সংস্কার করা হবে। সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃস্থাপন করা হবে।
২. প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সমপ্রীতিমূলক ‘রেইনবো-নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছতে হবে। এ জন্য একটি ‘জাতীয় সমঝোতা কমিশন’ গঠন করা হবে।
৩. ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।
৪. অর্থবিল, আস্থা ভোট, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং সংবিধান সংশোধনী বিল ব্যতীত অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হবে।
৫. প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ও সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হবে।
৬. ‘দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’প্রবর্তন করা হবে।
৭. কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করার লক্ষ্যে বর্তমান ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন’ সংশোধন করা হবে।
৮. সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হবে।
৯. বিচারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ গঠন করা হবে। ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা হবে। সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ড সংবলিত ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন করা হবে।
১০. ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করে প্রশাসন পুনর্গঠন করা হবে।
১১. সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা হবে।
১২. দুর্নীতি দমন কমিশন ও দুর্নীতি দমন আইন সংস্কারের পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা হবে।
১৩. সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অমানবিক, নিষ্ঠুর, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে।
১৪. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, অভিজ্ঞ ব্যাংকার, কর্পোরেট নেতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হবে।
১৫. ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’— এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন।
১৬. শ্রমজীবী মানুষ এবং চা-বাগান, বস্তি, চরাঞ্চল, হাওর-বাঁওড়, মঙ্গাপীড়িত, উপকূলীয় অঞ্চলের বৈষম্য দূরীকরণ এবং সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
১৭. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল করা হবে এবং অপ্রয়োজনীয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ করা হবে।
১৮. বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হবে।
১৯. দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে।
২১. রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হবে।
২২. যুব সমাজের ভিশন ও চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
২৩. নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নারীদের গুরুত্ব প্রদান এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
২৪. বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্যপর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-ক্যারিকুলামকে প্রাধান্য দেয়া হবে।
২৫. ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’— এই নীতির ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার নিমিত্তে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করা হবে।
২৬. শ্রমিকদের মূল্যসূচক ভিত্তিক ন্যায্যমজুরি নিশ্চিত করা হবে।
২৭. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। কৃষি জমির অকৃষি ব্যবহার বন্ধ করা হবে।