‘স্যার এবার যথাসময়ে নির্বাচন হবে! তো, অনেক বড় বড় সাহেবরা বলছেন— এবার নাকি ঠিক সময়ে নির্বাচন হবে না। দেশে নাকি অন্য কিছু ঘটতে যাচ্ছে। খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা কেউ নাকি ক্ষমতায় আসবেন না! অনেক বড় বড় সাহেব আমার রিকশায় চলতে চলতে এসব আলোচনা করেন। আপনারা তো সাংবাদিক মনে হয়, আসলেই কী এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে— জানেন কিছু?’ এভাবেই গতকাল সন্ধ্যায় গুলশান-২-এ কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা শহরে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময়ের রিকশাচালক হোসাইন আহমদ।
তিনি আরও বলেন, ‘তবে এবার বিএনপিও যতই লাফালাফি করুক না কেন, তারাও ভালো কিছু করতে পারবে না। তারাও ক্ষমতায় আসবে না। এই দলটার রাজনৈতিক নেতৃত্ব নাই। ভালো কিছু করতে পারবে না। এরা বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে থাকে। খালেদা জিয়ার আটকের পরও এরা কিছু করতে পারেনি।
তবে এদের অনেক সমর্থক আছে। একটা ভালো নেতার অভাবে সব কিছু শেষ। আর আওয়ামী লীগের ভালো নেতাও আছে-নেতৃত্বও আছে, তবুও এবার মনে হয় আগের মতো টিকে থাকতে পারবে না।’
হোসাইন আহমদের এ কথার রেশ ধরে আরো বেশ কিছু সাধারণ মানুষের সাথে কথা হয় আমার সংবাদের। রাজধানীর সচিবালয় এলাকায় স্টেশনারি দোকানদার আলমগীর হোসেনের কাছেও এ গুঞ্জনের খবর রয়েছে।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগের মতো হয়তো আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে না, অনেক বড় বড় স্যারদের আমার এখানে আড্ডা দিতে দিতে বলতে শুনেছি— ২০২৪ সালের প্রথম সপ্তাহে যে ভোট হওয়ার কথা তা নাকি হবে না। আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউ নাকি কিছু সময়ের জন্য আসবে না। কিছু মানুষ নাকি দেশটাকে নতুনভাবে সাজানোর পর তখন ভোট হবে। এরপর হয়তো আবারো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারে কিংবা বিএনপিও।’
সমপ্রতি এমন আশঙ্কার বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেছেন, ‘এবার নির্বাচন হবে কি-না, এটিও এখন বড় একটি কারণ রয়েছে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক সব কিছু মিলিয়ে হয়তো যথাসময়ে এবার নির্বাচন হবে না। বাংলাদেশে আগামীতে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, এখানে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের সীমাবদ্ধতা আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্লোগানের মধ্যে দিয়ে আদৌ নির্বাচন নাও হতে পারে। আমি মনে করি, এখন গণতন্ত্রের বিষয়টিকে উন্নত করা দরকার। আমরাও এবার ফেয়ার নির্বাচন চাই।
তবে যারা সরকার হঠাতে চায় তারা এখন জাতীয় সরকার চাচ্ছে। এটি আমাদের চিন্তা নয়। এ নির্বাচনের আগে-পরে অনেক কিছু ঘটবে। হয়তো আমরাও আর আওয়ামী লীগে থাকব না। অতীতে আমরা না গেলে আওয়ামী লীগ কিন্তু ক্ষমতায় আসতে পারত না। তবে এটিও বলতে হয়, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কথা। তার মতো বিচক্ষণ কেউ নেই।’
দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘এখানে বর্তমানে যে পরিস্থিতি, সেটিকে প্রধানমন্ত্রী এককভাবে ট্যাকেল দিতে চাচ্ছেন। প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে তিনি সমস্ত সংকটকে ট্যাকল দিতে চাচ্ছেন। সেখানে দেশের জনগণকে, রাজনীতিকদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টি অনুপস্থিত। ‘আমরা নির্বাচনের পক্ষে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার পক্ষে। আমরা চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে এই নেতা আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাথে যাওয়ার কারণে আমাদের দল কোনো বিকশিত হয়নি। আমারা দল রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগের সাথে যাইনি। আমাদের দলের যৌবনকাল শেষ। এখন বার্ধক্য চলছে। এক সময় এ দলের আর হয়তো থাকবে না।’
সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া শীর্ষ এক রাজনীতিবিদের সাথে কথা হলে তিনি নাম ব্যবহারে অনিচ্ছুক হয়ে দীর্ঘ প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সাক্ষাতে আমার সংবাদকে জানান, আগামী নির্বাচনে দেশে অনেক কিছুই ঘটবে। হয়তো নির্বাচন যথাসময় হবে না। সে বিষয়টিই আপাতত বেশি মজবুত রয়েছে। তবে এটি শক্তিশালী ও ভিত্তি মজবুত হতে হলে আরো দু-এক মাস নজর রাখতে হবে। আর সরকারবিরোধী যারা রয়েছে তারাও সমপ্রতি আকার ইঙ্গিতে জানিয়েছে— এরাও সরাসরি ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছে না। অর্থনীতিতে অভিজ্ঞ, আইন, বিচার বিভাগ সংস্কার ও মানুষের জীবন যাপনের স্বাভাবিক গতি নিশ্চিত করে তবেই ক্ষমতা চাওয়া। এর মধ্যে দেশের প্রথম সারির ব্যক্তিদের সম্মানিত করার ইঙ্গিত ও চুক্তি হয়েছে বলেও জানান এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
তিনি আরো বলেন, ‘এখন দেশের যে পরিস্থিতি আগামীতে কেউ ক্ষমতায় এলেও কেউ আর নেতৃত্ব দিতে পারবে না। অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। মেগাপ্রজেক্টের মাধ্যমে অনেক টাকা পাচার হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর খারাপ অবস্থা। বিচার বিভাগ নিয়ে প্রশ্ন, আন্তর্জাতিক নানা ইস্যু তৈরি হয়েছে— সেগুলোর আগে সমাধান আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে আগামীতে কিছু সময় দেশের নেতৃত্ব অন্য কারো হাতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদের মধ্যে দেশের অন্তত কয়েক ডজন শীর্ষ ব্যক্তি রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পর্দার আডালে কিছু ব্যক্তির নাম জানতে পারলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় তা উল্লেখ সম্ভব হচ্ছে না।
দেশের রাজনৈতিক যেকোনো পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন সম্ভব কি-না, জানতে চাইলে সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার আমার সংবাদকে জানিয়েছেন, নির্বাচনের জন্য একটি পরিবেশ আবশ্যক। রাজনৈতিক দলের সমঝোতা আবশ্যক। সেটি যদি পর্দার আড়ালেও সমাধান না হয় তাহলে কমিশনের পক্ষে অংশগ্রহণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। যেকোনো পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে কমিশন।
দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও বিরোধী রাজনীতি কোন পথে— জানতে চাইলে সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়া আমার সংবাদকে বলেছেন, ‘এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচন আগামীতে হবে না। তার অনেক প্রেক্ষাপট সামনে রয়েছে। এবার অতীতের মতো আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আর বাংলাদেশে হবে না— এটি ধরে নিতে পারেন। অনেকগুলো ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তা ধাপে ধাপে সামনে আসবে। কারণ সরকারের অধীনে নির্বাচনের আস্থা নষ্ট হয়েছে, এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও প্রমাণিত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে দৃশ্যগুলো দেখা যাবে। একটি দল রাষ্ট্র মেরামতের জন্য যে রূপরেখা দিয়েছে সেটি এখন সময়ের উপযোগী। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়ে যেটি বলা হয়েছে— এটি অত্যন্ত চমৎকার। তাদের এ বিষয়গুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, কে করবে সেটি পরে দেখা যাবে বলে তিনি যোগ করেন।