- বহু উদ্যোক্তার স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কা
- কর্মহীন হবেন অর্ধকোটি শিল্পকর্মী
- রপ্তানি কমলে ভাঙবে অর্থব্যবস্থা
- বেকারত্বে বাড়বে সামাজিক অনাচার
স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে শিল্প কারখানায় গ্যাস দেয়া জরুরি
—ইজাজ হোসেন, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
গ্যাস সংকটের কারণে দিনের অধিকাংশ সময় কাজ বন্ধ থাকে
—গোলাম রসূল, ইনচার্জ, লোটাস ইঞ্জি. ইন্ডাস্ট্রিজ লি.
২০২২ সাল অর্জন দিয়ে শুরু হলেও বছরের মাঝামাঝি এসে বিশাল ধাক্কা খেলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয় দেশবাসীকে। হুমকির মুখে পড়ে শিল্প ও বাণিজ্য খাত। উৎপাদন কমেছে অর্ধেকের বেশি। বন্ধ হয়েছে বহু কারখানা।
চাকরি হারিয়েছেন হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ। শঙ্কা আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে শুরু হলো নতুন বছর। নতুন বছরে কত শ্রমিক কর্মহারা হবেন, কত উদ্যোক্তার স্বপ্ন নিভে যাবে— জানা নেই কিছুই। গত বছরের শুরুতে শতভাগ বিদ্যুতায়ন ও স্বাধীনতা পদক অর্জনের হাঁক-ডাক শেষ না হতেই বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে বিদ্যুৎ খাত।
চলমান এই সংকট কেটে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে জ্বালানি বিভাগের কত সময় লাগবে তা জানে না সাধারণ মানুষ। গত বছর জ্বালানি তেলেও বেড়েছে রেকর্ড দাম। যার প্রভাবে কয়েক দফা বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। বেসামাল গতিতে মুদ্রাস্ফীতিতে ন্যূব্জ বাজার ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকলে কঠিন বিপদের মুখোমুখি হতে হবে।
রপ্তানি আয় কমলে ভেঙে পড়বে অর্থব্যবস্থা। কর্মবিমুখ হবে এক কোটি মানুষ। বাড়বে সামাজিক বিশৃঙ্খলা। অভাবে পড়ে অনেকে বেছে নেবে চুরি-ডাকাতি। কারখানার মালিকরা বলছেন, এভাবে আসন্ন গ্রীষ্মেও বিদ্যুৎবিভ্রাটের কবলে পড়লে পণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে উৎপাদনে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে অনেক। উৎপাাদন খরচও বাড়বে। দাম বাড়ার কারণে চাহিদাও অনেকাংশই কমে যেতে পারে বলে জানান এক ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা।
শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, গাজীপুরে প্রায় দুই হাজার ১৬৫টি নিবন্ধিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে পোশাক কারখানা এক হাজার ১৮৭টি। এর অধিকাংশে উৎপাদন এখন নিম্নগামী। ব্যবসায়ীরা বলেন, এখন ব্যাহত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা। শিল্প কারখানায় প্রায় অর্ধেক কমেছে উৎপাদন। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় বণিক সমিতি বিজিএমইএ বলছে, জ্বালানি সংকটের কারণে সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে হুমকিতে পড়বে দেশের তৈরি পোশাকশিল্প।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দীর্ঘ ছয় মাস ধরে প্রথমে বিদ্যুৎ সংকট ও পরে জেনারেটরে ব্যবহূত গ্যাসের সংকট তাদের বিপাকে ফেলেছে। সাভার-আশুলিয়া এলাকায় প্রায় ছয় শতাধিক নিটিং ও ডায়িং এবং চার শতাধিক টেক্সটাইল কারখানায় বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে গ্যাস জেনারেটর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে তীব্র লোডশেডিংয়ে হাহাকার অবস্থা। বিকল্প হিসেবে গ্যাস ব্যবহারে ঝুঁকেছে অনেকে। এখন গ্যাসেও সংকট। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম অসম্ভব বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। ছোট কারখানার নতুন উদ্যোক্তারা আশাহত হয়ে পড়েছেন। ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার চিন্তাও করছেন অনেকে। বাসাবাড়ি থেকে শিল্প-কারখানা সব খাতেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলা করতে হয়। আসন্ন গরম বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের সংকট ভোগাতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
২০২২ সালে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম এক দফা বাড়ানো হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। দেশের ক্রান্তিকালে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ চায়। আইএমএফ পর্যকেক্ষক টিম নানা শর্তের ফাঁদ তৈরি করে। শর্তে একটি হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো। এদিকে সরকাররের তরফ থেকে বলা হচ্ছে ভর্তুকি বহন করা সুযোগ নেই। এর ভার গ্রাহককেই বহন করতে হবে। ফলে আবারও বাড়ছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম।
এদিকে সংকটের কথা স্বীকার করে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানায়, সমস্যা সমাধান হবে শিগগিরই। নারায়ণঞ্জের চাষাড়া, ভুলতা, রূপগঞ্জ, তারাবো, গাউছিয়ায় অসংখ্য পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। উৎপাদন হ্রাসে শঙ্কিত শ্রমিক-মালিক সবাই। এক দিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া অন্যদিকে উৎপাদন হ্রাসের ফলে চাকরি হারানোর আতঙ্কে আছেন অনেক কর্মচারী। অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে না পারায় ঝুঁকির কথাও জানান তারা। এদিকে সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানাসহ টেক্সটাইল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে সমহারে।
সংকটের মধ্যেও ২০২২ সালে জ্বালানিতে খরচ বেড়েছে গ্রাহকদের। গত ৫ জুন গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ২৩ শতাংশ। ৫ আগস্ট ডিজেল-পেট্রোলের দাম রেকর্ড ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায় সরকার। এতে গাড়ি ভাড়াসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুর দাম বেড়ে যায়। যদিও ২৯ আগস্ট লিটারে মাত্র পাঁচ টাকা করে কমানো হয়। ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম প্রায় ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়।
গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর গণশুনানি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হবে। আইএমএফের ঋণ পেতে ভর্তুকি কমানোর চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। তাই বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম আগামীতে আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এর মধ্যেই আইন সংশোধন করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকার এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছ থেকে নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও ডলার সঙ্কটে আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে দেশের অনেক ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে ধারাবাহিকভাবে কমছে এলসি খোলার হার।
এমনকি দেশের অন্তত ২০টি ব্যাংকের কাছে ঋণপত্র (এলসি) দায় মেটানোর মতো কোনো ডলার নেই। যার কারণে জ্বালানি আমদানি এক প্রকার বন্ধ হয়ে পড়ে। এতে গত বছর ১৯ জুলাই থেকে সরকার ডিজেল সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং ঘোষণা করে। পরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আগস্টে বিদ্যুৎ সংকট কেটে যাবে। কিন্তু কোনো সমাধান হলো না। এভাবে সেপ্টেম্বর তারপর অক্টোবর, নভেম্বরে পার করে বছর শেষে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের আশ্বাস দেন। এদিকে শীতের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অনেকাংশ কমে যাওয়ায় লোডশেডিং কনেকটা কমে গেছে।
আশুলিয়ার লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জেনারেটর ইনচার্জ গোলাম রসূল বলেন, ‘বর্তমানে শীতে গ্যাস সংকটে দিনের অধিকাংশ সময় কাজ বন্ধ করে অলস সময় পার করছেন এখানকার শ্রমিকরা। এখন গড়ে প্রতিটি কারখানায় ৫০ থেকে ২০ পিএসআই পর্যন্ত গ্যাসের চাহিদা থাকলেও তারা পাচ্ছেন গড়ে এক থেকে পাঁচ পিএসআই পর্যন্ত।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘শিল্পে দিনে গ্যাস প্রয়োজন ৯০ কোটি ঘনফুট। দেয়া হচ্ছে ৫০ কোটি ঘনফুট বা তার কম। গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের কারখানায় গ্যাস সংকট সবচেয়ে বেশি। স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে এসব এলাকার কারখানায় গ্যাস দেয়া জরুরি। সাথে অপচয় রোগ করা গেলে সুবিধা পাবে শিল্প কারখানা। এতে স্বাভাবিক থাকবে উৎপাদনের গতি।’