- আ.লীগ, জাতীয় পার্টি বলছে— আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী
- বিএনপি, চরমোনাইসহ অনেকের দাবি— সংবিধান পরিবর্তন-সংস্কার
- শিশুদের রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলন বিফল হলেও দ্বাদশে জলঘোলার আশঙ্কা
- রাজনীতিতে ২০২৩ সালটি অনিশ্চিত স্পর্শকাতর বলে অনেকের দাবি
আ.লীগ ক্ষমতায় থাকতে আর বিএনপি ক্ষমতায় যেতে অন্যতম অস্ত্র সংবিধান
—মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
অনেক মৌলিক দুর্বলতা আছে, সংবিধান সংস্কারের দাবি যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয়
—হাসনাত কাইয়ূম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক
বর্তমান সংবিধানে কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট নয় সামগ্রিক সংশোধনের আবশ্যক রয়েছে
—সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, চরমোনাই পীর
চব্বিশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে সংবিধান নিয়ে বিতণ্ডা শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বলছে আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। কেউ জলঘোলার চেষ্টা করলেও লাভ হবে না। অন্যদিকে বিএনপি জামায়াত ও ইসলামপন্থি দলগুলো দাবি তুলেছেন রাষ্ট্র সংস্কারের।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও সরকারের পদতাগের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। প্রয়োজনে আবারও সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সংযুক্তের আহ্বান। ভোটের এক বছর আগে এমন রাজনৈতিক বাকযুদ্ধকে সূক্ষ্মভাবে দেখেছেন দেশের প্রথম সারির নাগরিকরা।
তারা বলছেন, ২০০৯ সাল থেকে একটানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। তাদের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি। এ দলটি ক্ষমতার বাইরে আছে ১৬ বছর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যেতে মরিয়া। তাদের অন্যতম অস্ত্র হলো বর্তমান সংবিধান। এটি পবিত্র আমানত, বদলানো যাবে না। বিএনপি চায়, সংবিধানের সংশোধন। এতে করে এবার ভোটের আগেই উত্তেজনা শুরু হয়েছে। অতীতে অনেকে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তুলেছেন আকস্মিক। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় শিশুরা রাষ্ট্র মেরামতের দাবি তুলে। সড়কে তাদের শৃঙ্খলা দেশ-বিদেশে প্রশংসায় ভাসে। কিন্তু বেলাশেষে তাদের শৃঙ্খলিত বিষয় অধিকারে যুক্ত হয়নি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নাগরিক অধিকারের বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় কিন্তু সেটির অবস্থানও এক পর্যায়ে এসে অম্লান হয়। কিন্তু এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩২টি রাজনৈতিক দল, দেশের কিছু নাগরিকও নানা ইঙ্গিত বহন করায় এবার সংবিধান বিতণ্ডায় অজানা শঙ্কা কাজ করছে। পরিকল্পিতভাবে অনেকে বড় অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন। তাই ক্ষমতাসীন দলও অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দেখছেন। মোকাবিলা করছেন।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চোখ রাখা ব্যক্তিরা বলছেন, এ পর্যন্ত সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। তার কতটা জনগণের স্বার্থে আর কতটা শাসকদের স্বার্থে, সেই প্রশ্নও অতীতেও ছিল এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। ভোটের আগে এবার নির্বাচনব্যবস্থা পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে আগাম দাবি তুলেছে— এর উদ্দেশ্যের পেছনেও রহস্য রয়েছে। তা কতটা দেশের স্বার্থে তা সময়ের সাথে অবশ্যই দৃশ্যমান হবে।
বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘিষ্ঠ ভোটারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করে। যারা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে, তারা প্রায়ই ৩১ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এতে ৬০ শতাংশ বা তদূর্ধ্ব মানুষ সরকারে তার প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত হয় ভোটাররা এখানে গৌণ। ভোটের রাজনীতির এ এক অগ্নিপরীক্ষা। এবার ২০২৩ সালটি হবে খুবই অনিশ্চিত, স্পর্শকাতর ও আতঙ্কের।
সংবিধান ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে এবার ভোটের মাঠে আগেই গরম হাওয়া। গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকায় খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। তাদের কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। একজন গুলিতে মারাও গেছেন। তবুও তারা মাঠ ছাড়েননি। বিকল্প হিসেবে গোলাপ বাগে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন। সেখান থেকে ১০ দফা ঘোষণা করা হয়। দেয়া হয় কর্মসূচি। তার আলোকে গতমাসের ২৪ তারিখ সারা দেশে গণমিছিল ও ঢাকায় ৩০ তারিখে বড় শোডাউন করা হয়। ৩২টি দল ওইদিন ঢাকায় রাস্তায় নামে।
আবার আগামী ১১ তারিখ ঢাকায় রয়েছে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা। এর আগে বিভাগীয় শহরগুলোয় একের পর এক সমাবেশ করে তাক লাগিয়ে দেয়। সরকারের অনুগতরা নানান ছুতায় বাধা দিলেও সমাবেশগুলো সফল হয়। আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, এটি তাদের জন্য উদ্বেগের। মাঠ না বেদখল হয়ে যায়! শুরু হয়ে যায় আওয়ামী লীগের নানান অঙ্গসংগঠনের সম্মেলন, সমাবেশ, মিছিল। এদিকে জাতীয় পার্টিকে বশে রাখতে নানান অঙ্ক কষছে আওয়ামী লীগ। দলের প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর সেখানে কিছু দিন ছিল দেবর-ভাবির ঝগড়া। পরে একটি আপস হয়েছিল। সেটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। হাসপাতালের বিছানা থেকে উদয় হয়েছেন দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকা সংসদে বিরোধী দলের নেতা।
এদিকে দলের চেয়ারম্যান কর্তৃত্ব ফিরে পেতে কোর্টে দৌড়াচ্ছেন। সরকারের সাথে বৈঠকের পর বিএনপির পদত্যাগ হওয়া আসনগুলোতে নজর দিয়ে আবারো সরকারের সুরে কথা বলছেন দলটি। সরকারের নীতিনির্ধারণী ফোরাম যেমন বলছেন আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান মেনে তেমনি জাতীয় পার্টিও বলছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘সংবিধানে যেভাবে নির্বাচনের কথা বলা আছে সেভাবেই নির্বাচন হবে। ভোটাধিকার প্রয়োগে কেউ বাধা দিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল। ২০২৪ এর শুরুতে যে নির্বাচন হবে তাতে সব দল অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করছি।’ জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেছেন, ‘আমার দল কখনো ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। আগামী জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির (জাপা) অংশ নেবে। সংবিধান অনুযায়ীই হবে আগামী নির্বাচন। কেউ সংবিধান নিয়ে ষড়যন্ত্র করলেও লাভ হবে না।’
এ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘একটি দেশের সংবিধান হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। যাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। তাই এ ধরনের বিষয় নিয়ে রসিকতা করা যায় না। নাগরিকের জন্য আইনের শাসন ও সুবিচার নিশ্চিত করা হবে সংবিধানের প্রস্তাবনায় লেখা আছে। যার ফলে রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে বিএনপি ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে।
আজকে যে গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করেছি সেই গণতন্ত্রের অবস্থা কী? গণতন্ত্রের প্রধান বাহন হলো নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে বাংলাদেশে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। বিরোধী দলের প্রার্থীকে ভোট করতে দেয়া হয় না। প্রচারণা চালাতে দেয়া হয় না। অর্থাৎ ভোট ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সরকার দলীয়করণের মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস ও নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে।’
ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধনের আবশ্যক রয়েছে। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র তথা সংবিধানকে যথেচ্ছা সংশোধন করে জনঅধিকার খর্ব করার ঢাল বানানো হয়েছে। বর্তমান সংবিধান নিয়ে দেশের কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট নয়। বিরোধীরা এটিকে সংস্কার করতে চাইছে। সরকার পক্ষও বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরত যাওয়ার কথা বলে বর্তমান সংবিধানের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো এই সংবিধান রচনায় জনমতের তোয়াক্কা করা হয়নি।
পাকিস্তান আমলের ‘পার্লামেন্ট মেম্বারদের’ দিয়ে এই সংবিধান পাস করানো হয়েছে। এই সংবিধান প্রণয়নে গণভোটও হয়নি। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও চলমান গণঅসন্তোষ বিবেচনায় ইসলামী আন্দোলন এ ভূখণ্ডের মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য বোধ, বিশ্বাস ও মনস্তত্ত্ব আমলে নিয়ে এবং গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধনের প্রস্তাব করছে।
সমপ্রতি এ সংক্রান্ত বিষয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ এক প্রবন্ধে লেখেন, দেশের রাজনীতিতে প্রধান পক্ষ দুটি। একটি হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারা ২০০৯ সাল থেকে একটানা ক্ষমতায় আছে। তাদের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি। তারা ক্ষমতার বাইরে আছে ১৬ বছর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যেতে মরিয়া। তাদের অন্যতম অস্ত্র হলো বর্তমান সংবিধান। এটি পবিত্র আমানত, বদলানো যাবে না। বিএনপি চায়, সংবিধানের সংশোধন। বর্তমান ব্যবস্থা চালু থাকলে কিংবা সংবিধান সংশোধন করা হলে তার নতিজা কী হবে, তা উভয় পক্ষ ভালো করেই জানে। সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর এই অবস্থানে সংকট বাড়ছে, জল আরও ঘোলা হচ্ছে।’
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের যে দাবি এখন উঠেছে, সে দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয়। আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীনদের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা না থাকা। সংবিধান অনুযায়ীই রাষ্ট্র, সরকার এবং সরকারি দল সবকিছু একাকার।
সরকারপ্রধানের ক্ষমতার কোনো সীমারেখা নেই এবং তিনি সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতাবদল বা সরকার বদলের পথ রুদ্ধ, অর্থাৎ নির্বাচনব্যবস্থা সংবিধান মোতাবেকই অকার্যকর। রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণের কাজ সরকারের ইচ্ছার অধীন। সংসদ, অর্থাৎ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাহী বিভাগের অধীন করে রাখা।
রাষ্ট্র পরিচালনার দমনমূলক ঔপনিবেশিক আইনগুলোকে অক্ষত রাখা এবং প্রশাসনকে বহাল রাখা। আরও অনেক অনেক মৌলিক দুর্বলতা আছে। তবে এর সব কিছুকে খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির সঙ্গে ক্ষমতাকাঠামোর বৈপরিত্য।’