বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন তিন দশক ধরে বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করছেন। আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এই প্রকৌশলী ১৯৯৬ সালে পাওয়ার সেলে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি বিভিন্ন মেয়াদে উপপরিচালক ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২০১৩ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রকৌশলীদের পেশাদারি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের নির্বাচিত ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
এ ছাড়া তিনি South Asian Regional Initiative (SARIE/I)-এর স্টিয়ারিং কমিটির ২০২১-২২ মেয়াদে চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এসকাপের জ্বালানি-বিষয়ক কমিটির (২০১৯-২১) মেয়াদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। চলমান জ্বালানি সংকট ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন আমার সংবাদের নিজস্ব প্রতিবেদক মহিউদ্দিন রাব্বানি ও আলমগীর হুসাইন।
আমার সংবাদ : বিদ্যুতে চলমান সংকটে নতুন বছরে কী সুখবর দেবেন?
প্রকৌশলী মেহাম্মদ হোসাইন : চলমান শীত মৌসুমে নভেম্বর থেকে আমরা লোডশেডিংমুক্ত আছি। এই অবস্থা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। মার্চে গরম বাড়বে। তা ছাড়া বোরো ধনের মৌসুমে সেচে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াটের চাপ থাকবে। সামনের রমজানেও বিদ্যুতের চাহিদা বড়বে। এতে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ চাহিদা থাকবে। তবে আশা করি, আমরা ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারব। এতে আমাদের ঘাটতি সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট থাকে। এর মধ্যে রামপাল থেকে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, বরিশালের পায়রা থেকে ৩৫০ মেগাওয়াট এবং ভারতের আদানি থেকে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাবো। এর মাধ্যমে আমার আমাদের চাহিদার কাছিকাছি পৌঁছতে পারব। আমারা এখনই লোডশেডিংমুক্ত না হতে পারলেও একটি সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারব। স্বস্তি পাবে গ্রাহক।
আমার সংবাদ : দুই দশের বেশি সময় ধরে পাওয়ার সেলে দায়িত্ব পালন করছেন। এই সময়ে পাওয়ার সেলের অর্জন কী?
প্রকৌশলী মেহাম্মদ হোসাইন : পাওয়ারসেল মূলত তৈরিই হয়েছে বিদ্যুৎ খাতের সংস্কারের জন্য। এক সময় পিডিবি একাই বিতরণ, উৎপাদন ও সঞ্চালন করত। আমরা তা পরিবর্তন করেছি। এতে কাজগুলোও ভাগ হয়ে গেছ। এখন সঞ্চালনের দায়িত্ব পালন করেন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ-পিজিসিবি। বিতরণে ছয়টি কোম্পানি কাজ করছে। জেনারেশন করছে সাতটি প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে আমরা উৎসাহিত করি। সাফল্যের মধ্যে এখন মোট উৎপাদনের ৪২ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। এ ছাড়া আগে আমাদের সিস্টেম লস ছিল ২৫ শতাংশ তা ২৫ বছরে এখন ৮ শতাংশে কমিয়ে এনেছি। ইতোপূর্বে সাত-আট মাসের বকেয়া আমরা দুই মাসে নামিয়ে এনেছি। নিয়মিত কাজগুলোর মধ্যে সবগুলো দপ্তর-কোম্পানির সাথে সমন্বয় করা সাধন করি আমরা। নীতিনির্ধারণী সংস্থা হিসেবে পাওয়ার সেল যেকোনো উদ্ভাবনী বিষয়ে মতামত প্রদান করে।
আমার সংবাদ : আমদানি-নির্ভর জ্বালানি মাধ্যমে শতভাগ বিদ্যুতায়নকে কিভাবে দেখছেন?
প্রকৌশলী মেহাম্মদ হোসাইন : সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াট আমাদের ক্যাপাসিটি আছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নে কেন গেলাম সেটি তো গ্রাহক পর্যায়ে প্রশ্ন নেই। সবাই তো বিদ্যুৎ চায়। এটি সবার অধিকার। সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে— এটিই তো হওয়ার কথা। সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, দেশের সব নাগরিকের জীবনমান উন্নয়নের বিদ্যুৎ পৌঁছাতে হবে। এটি অধিকার হিসেবে দিতে হবে। পাশের বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকবে আমার বাড়ি থাকবে না— এটি তো বৈষম্য। সাংবিধানিক অধিকার বাস্তবায়নে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা জরুরিই ছিল। এখন সরকার সেটি আমদানি করে হোক বা অন্য কোনো উপায়ই হোক।
আমার সংবাদ : আসছে গ্রীষ্মে লোডশেডিং কেমন থাকবে? নাকি তার আগেই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব?
প্রকৌশলী মেহাম্মদ হোসাইন : আসন্ন গ্রীষ্মে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হবে। তবে এখনই শতভাগ লোডশেডিংমুক্ত হচ্ছে না। আমরা রামপাল থেকে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, বরিশালের পায়রা থেকে ৩৫০ মেগাওয়াট ও ভারতের আদানি থেকে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাবো। এতে আমার আমাদের চাহিদার কাছিকাছি পৌঁছতে পারব।
আমার সংবাদ : পাওয়ার সেল বিদ্যুৎ খাতে কি কি গবেষণা করছে?
প্রকৌশলী মেহাম্মদ হোসাইন : বিদ্যুৎ সেক্টরে আমাদের ১৪টি প্রতিষ্ঠান আছে। আর গবেষণার জন্য বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল-বিইপিআরসি আছে। মূলত গবেষণার কাজ তারা করে। আমরা বিদ্যুতের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এ ছাড়া গ্রাহকের সুবিধা-অসুবিধা নিয়েও কাজ করি। কোম্পানিগুলো ঠিকমতো গ্রাহকসেবা দিচ্ছে কি-না সে বিষয়ে মনিটরিং করি।
আমার সংবাদ : চলতি বছরে মার্চে ভারতের আদানি থেকে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে। সংকট কতটুকু দূর হবে?
প্রকৌশলী মেহাম্মদ হোসাইন : মার্চে ভারতের আদানি থেকে বিদ্যুৎ আসবে। তবে তা এখনই পুরোটা আসবে না। পর্যায়ক্রমে আসবে। এখন আপতত ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে। আমরা তো লোডশেডিংমুক্তই ছিলাম। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে জ্বালানি খাতে যে চাপ এসেছে তার প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশেও। আগস্টে আমরা বলেছিলাম, অক্টোবর নাগাদ সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ব্ল্যাকআউটসহ বিভিন্ন কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। পরে আবহাওয়া পরিবর্তনে (শীত আসায়) নভেম্বর থেকে লোডশেডিংমুক্ত আছি। মার্চে গরম বাড়বে। বাড়বে বিদ্যুতের চাহিদাও। ভারতের আদানির বিদ্যুৎ আমাদের জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখবে। আমরা আশা করছি সংকট অনেকটা কাটবে।
আমার সংবাদ : তীব্র জ্বালানি সংকটে ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। সংকট মুহূর্তে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
প্রকৌশলী মেহাম্মদ হোসাইন : প্রধানমন্ত্রী রপ্তানি খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। বৈদেশিক মুদ্রার জন্য রপ্তানি আয় দরকার আমাদের। আমাদের অর্থব্যস্থা ভালো। আমরা শুধু বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে পড়েছি। রপ্তানি-ভিত্তিক কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক কাজে যেন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় সেটি আমরা দেখছি। আমরা যখন এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ে গেলাম তখনো রপ্তানি শিল্পকে গুরুত্ব দিয়েছি এবং চেষ্টা করেছি তাদের লোডশেডিংয়ের বাইরে রাখতে।
আমার সংবাদ : আপনাকে ধন্যবাদ। আমার সংবাদ পরিবারের পক্ষ থেকে আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
প্রকৌশলী মেহাম্মদ হোসাইন : আপাদেরও ধন্যবাদ।