আবারও ভয়ঙ্কর উগ্র হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ঘরে ঢুকে প্রকাশ্যে খুনের ঘটনা ঘটছে। প্রায় প্রতিদিনই ক্যাম্প এলাকায় কোনো না কোনো সন্ত্রাস ও অপরাধের খবর আসছে প্রশাসনের কাছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনার মধ্যেও অস্ত্রধারী রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সর্বশেষে গত ১২ ঘণ্টার ভেতরে ক্যাম্পে দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। একজনকে ঘরে ঢুকে গুলি করে, আরেকজনকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়েছে। এ নিয়ে ক্যাম্পের লোকজন ভয়ভীতির মধ্য দিন কাটাচ্ছেন।
দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে খুনোখুনি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলে আসছে। প্রশাসনের অভিযানে অস্ত্র-মাদকসহ সবসময় আটকের খবর রয়েছে সংবাদপত্রে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, গত এক বছরে ৩০ রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছেন, অপহরণ ও আহতের সংখ্যাও প্রায় ১০০-এর কাছাকাছি।
২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়। এর আগেও ক্যাম্পে খুনোখুনি হয়েছে। তবে মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর ক্যাম্পগুলোর ভেতরে অপরাধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রশাসন। সাধারণ রোহিঙ্গাকে খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম দিনে আরো বাড়তে থাকে।
এখন পুরোনো রোহিঙ্গারা বিশেষ মাধ্যমে পাসপোর্ট বানিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের বিদেশে পাঠাচ্ছেন। কেউ প্রতিবাদী হলে আরসা সদস্যরা গভীর রাতে তাকে পাহাড়ে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের মাধ্যমে বড় একটি অংশ নিয়মিত অস্ত্র ও মাদক নিয়ে আসছে দেশে। এখন ক্যাম্পে নতুন আতঙ্ক হয়ে উঠছে গ্রেনেড উৎস।
আরসার গুলিতে রোহিঙ্গা সাব মাঝি খুন : কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে এক রোহিঙ্গা নেতা (সাব মাঝি) খুন হয়েছেন। গতকাল রোববার ভোরে উখিয়া বালুখালী ক্যাম্প-৮ ইস্টে এ ঘটনা ঘটে। উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা সাব মাঝি মোহাম্মদ সেলিম (৩৫) উখিয়া উপজেলার বালুখালী ৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-ব্লকের আব্দুস সোবহানের ছেলে। তিনি ওই ক্যাম্পের বি-ব্লকের সাব মাঝি।
ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, মাঝি সেলিমকে ভোরে ঘর থেকে ঢেকে নিয়ে আরসা নামধারী একদল দুষ্কৃতকারী তাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছলে দুষ্কৃতকারীরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। উখিয়ার বালুখালী কুতুপালং ক্যাম্প-৮-এর মোহাম্মদ জাফর জানান, সাব মাঝি ক্যাম্পে আরসা বিরোধীরা সবসময় সোচ্চার ছিল। হয়তো সেখানে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ক্যাম্পে সন্ত্রাসী গ্রুপ আবারও সক্রিয় হয়েছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে গ্রেনেডের উৎস খুঁজছে পুলিশ : কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ৮-ইস্ট রোহিঙ্গা শিবিরে হামলার সময় শুক্রবার একটি গ্রেনেড ছোড়া হয়। অবিস্ফোরিত গ্রেনেডটি শিবিরের বস্তিতে ঘিরে রাখে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা। পুলিশ বলছে, গ্রেনেডটির উৎস খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে সেনাবাহিনীর বোমা বিস্ফোরক দল গত শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, শিবিরের মোহাম্মদ নবী নামের যে রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তার ঘরে পাওয়া গ্রেনেডের উৎস খুঁজে বের করতে আমরা কাজ করছি। এটি কি মিয়ানমারের, নাকি ভিন্ন কোনো দেশের তৈরি সেটিও দেখা হচ্ছে।
মোহাম্মদ নবী নামের রোহিঙ্গার ঘরে সশস্ত্র হামলা চালায় আরসা হিসেবে পরিচিত ১০-১২ জনের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একটি দল। সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে তিনি আহত হয়ে বর্তমানে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা মোহাম্মদ নবী জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন, তাকে হত্যার উদ্দেশেই সন্ত্রাসীরা গ্রেনেডটি নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু ভাগ্য ভালো এটির বিস্ফোরণ ঘটেনি।
পুলিশ আহত রোহিঙ্গার এমন তথ্য সত্যি কি-না তা যাচাই-বাছাই করছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছুদ্দৌজা নয়ন বলেন, গ্রেনেডের ঘটনাটি মোটেই হেলাফেলার নয়। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক ঘটনা। আমরা দেশি-বিদেশিদের বলছি, সরকারের নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
জামতলী ক্যাম্পে আরসার ছুরিকাঘাতে রোহিঙ্গা নেতা নিহত : উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার ছুরিকাঘাতে এক রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা (মাঝি) নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। গত শনিবার রাতে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ১৫ নম্বর জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ ঘটনা ঘটে। নিহতের নাম মোহাম্মদ রফিক। তিনি ১৫ নম্বর ক্যাম্পের প্রধান নেতা ছিলেন। এ বিষয়ে উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, দুর্বৃত্তের হামলায় এক রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা নিহত হয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল নিয়ে আসে। অপরাধীদের ধরতে পুলিশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর রয়েছে।
টেকনাফে অস্ত্র ঠেকিয়ে চার কৃষক অপহরণ চলছে অভিযান : কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নে ক্ষেত পাহারা দেয়ার সময় চার কৃষককে অপহরণ করেছে সন্ত্রাসীরা। গতকাল রোববার ভোরে হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকায় ভোট্টা ক্ষেত পাহারা দেয়ার সময় ১৫-২০ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ অস্ত্র ঠেকিয়ে তাদের তুলে নিয়ে গেছে বলে জানায় স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবার।
অপহূতরা হলেন— হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে আব্দুস সালাম, গুরা মিয়ার ছেলে আব্দুর রহমান, রাজা মিয়ার ছেলে মুহিব উল্লাহ ও রাজা মিয়ার ছেলে আব্দুল হাকিম। অপহূত আব্দুস সালামের ছোট ভাই মুন্সী রফিক বলেন, রাতে পাহাড় থেকে বন্যহাতির দল ভুট্টা ক্ষেতে এসেছিল। তাদের পাহাড়ের দিকে তাড়িয়ে দিয়ে টংয়ে এসে ঘুমিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে তাদের অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। সকালে আমরা ক্ষেতে গিয়ে তাদের জুতা আর রক্তের দাগ পেয়েছি।
এখন কী হবে জানি না। ইউপি চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি বিষয়টি। হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, অপহরণের খবর পেয়েছি। চারজন কৃষককে তুলে নেয়া হয়েছে। আমরা বারবার বলেছি একটি অভিযানের। অপহরণের বিষয়টি থানা পুলিশকে অবহিত করেছি। বিষয়টি নিশ্চিত করে টেকনাফ থানার ওসি মো. আব্দুল হালিম বলেন, অপহরণের খবর পেয়েছি। উদ্ধার অভিযানের জন্য দুটি টিম কাজ করছে।
পুরোনো রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বিদেশ যাচ্ছে রোহিঙ্গারা : দালালের হাত ধরে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজার থেকে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে পাসপোর্ট করে বৈধভাবে কিংবা সাগর পথে পাচার করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। কক্সবাজারে পাসপোর্ট তৈরিতে কড়াকড়ি হওয়ায় ভিন্ন জেলার অফিস থেকেই তৈরি করা হচ্ছে পাসপোর্ট। এ ছাড়া পাসপোর্টবিহীনদের সাগরপথেই পাচার করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত তিন দালাল চক্রের হাত ধরে বর্তমানে পাসপোর্ট তৈরি করছে রোহিঙ্গারা।
তারা হলেন— কক্সবাজার জেলার পাহাড়তলীর ইসলামপুর গ্রামের মৌলভী নুর হোসেন, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাত্তারঘোনা গ্রামের আবদুস ছবির ছেলে হাফেজ আহম্মেদ ও রামু থানার ৬ নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ মিঠাইছড়ির নিজেরপাড়া গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে সাইফুল ইসলাম। এদের মধ্যে মৌলভী নুর হোসেন ও হাফেজ আহম্মদ রোহিঙ্গা। অনেক বছর আগে থেকেই বাংলাদেশে বসতি গেড়ে পাসপোর্ট তৈরির কাজ করে আসছে তারা। সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলাসহ নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি করতে কাজ করছে হাফেজ আহম্মদ। তবে কক্সবাজারে প্রশাসনের নজরদারি বেশি হওয়ায় পাসপোর্ট তৈরিতে ভিন্ন জেলার দিকে ঝুঁকছে এই দালাল চক্র।
এ ছাড়াও অন্যান্য জেলায় পাসপোর্ট তৈরিতে কাজ করছেন নুর হোসেন ও সাইফুল ইসলাম। এদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া অনেক পুরোনো রোহিঙ্গা। খুরুস্কুল ডেলপাড়ার বাসিন্দা সোলতান আহমদ জানিয়েছেন, মূলত স্থানীয়দের একই নামের জন্মসনদ দিয়ে তৈ িকরা হচ্ছে পাসপোর্ট। এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বহু বছর আগে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে ঘাঁটি গেড়েছে তারাই মূলত এ ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত। তবে, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
কোনোভাবেই যেন কোনো রোহিঙ্গা পাসপোর্ট তৈরি করতে না পারে সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবলম্বন করা হচ্ছে। বহু বছর আগে এসে যারা বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে গেছে তাদেরকেও পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে না।