- প্রথম পর্ব ১৩-১৫ জানুয়ারি
- রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর পৃথক বাণী
- মার্কিন নাগরিকদের ভ্রমণে সতর্কতা
- প্রশাসনের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার
টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হলো বিশ্ব ইজতেমা। অতিমারি করোনার কারণে টানা দুই বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের ৫৬তম সম্মিলন। মুসলমানদের অন্যতম দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় এ জমায়েতে পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে তাবলিগ জামাতের লোকেরা ছুটে আসেন এখানে। মুসল্লিরা তুরাগ থেকে ধর্মের বুনিয়াদি জ্ঞান হাসিল করে বেরিয়ে পড়েন দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেন ইসলামের শাশ্বত বাণী।
নিজেদের ইমান-আমল-আখলাক সুন্দর করার পাশাপাশি অপরাপর মুসলিমদের জীবন গঠন ও সুন্দরের চিন্তা নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ান দেশে-বিদেশে। ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরও দাওয়াত দেন তারা। কথাবার্তা, খাবার-দাবার, চালচলন সব কিছুতেই সাধারণ জীবনমান পদ্ধতি অবলম্বন করেন তারা। আল্লাহর রঙে রঙিন করতে চান নিজেদের। লক্ষ্য তাদের আল-কুরআন ও সুন্নাহের পথ আঁকড়ে ধরা।
এবার দুই ভাগে বিশ্ব ইজতেমা করেছে দুপক্ষ। মাঝখানে মহামারির কারণে দুই বছর ইজতেমার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। আগে এক মঞ্চ থেকে একবারই বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন হতো। কিন্তু মাওলানা জোবায়ের এবং মাওলানা সা’দ পক্ষের অনুসারীরা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদে জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে দুপক্ষ বিশ্ব ইজতেমা দুইবারে করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এবার মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীরা প্রথম পর্বে ১৩-১৫ জানুয়ারি এবং মাওলানা সা’দ পক্ষের অনুসারীরা ২০-২২ জানুয়ারি ইজতেমা পরিচালনা করবেন। প্রতি পর্বেই শেষ দিনে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ইজতেমা শুরু হলেও বৃহস্পতিবারই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় টঙ্গীর তুরাগ পাড়ের মাঠ।
সারা দেশ থেকে আসা লাখো ধর্মপ্রাণ মুসল্লির পদচারণায় মুখরিত টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দান। আনুষ্ঠানিকভাবে ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয় গতকাল শুক্রবার। গতকাল জুমার নামাজে লাখো মুসল্লির মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ইজতেমায় আগত অনেকে গতকালের জুমার জামায়াতকে হজ ও ওমরাহর পর বৃহৎ জমায়েত বলে ধারণা করেছেন।
বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে শিল্পনগরী টঙ্গী এখন ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। মুসল্লিদের উপস্থিতিতে ইজতেমা মাঠ পূর্ণ হয়ে সড়ক ও ফুটপাত বন্ধ হয়ে গেছে। খোলা জায়গাগুলোও মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। ইজতেমায় আগত মুসল্লি ও দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, এবারের ইজতেমার জমায়েতে অতীতের সব রেকর্ড ভাঙবে।
ইজতেমাকে কেন্দ্র করে আগত মুসল্লিদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা গেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই বছর ইজতেমা বন্ধ থাকায় এবার লোকে লোকারণ্য হবে ইজতেমা মাঠ। থাকা-খাওয়ায় প্রচণ্ড সমস্যা থাকলেও হাসিমুখে তারা বলছেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই এসব কষ্টের উত্তম বিনিময় দেবেন। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে যাবতীয় কষ্ট বিসর্জন দিয়েও হাজির ইজতেমা ময়দানে।
তীব্র শীত উপেক্ষা করে সারা দেশ থেকে বৃদ্ধ-যুবক সব বয়সিরা তুরাগ পাড়ে এসে হাজির। দীর্ঘ যানজটসহ নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হওয়ার পর আর যেন দুঃখ থাকে না। এক নিমিষেই যেন যাবতীয় গ্লানি মুছে যায়।
রংপুর থেকে আগত আব্দুল রহিম বলেন, তীব্র শীত উপেক্ষা করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ইজতেমায় এসেছি। ইজতেমা শুরুর একদিন আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। আমাদের আরও অনেক জামাত আসতে পারছে না ভিড়ের কারণে। আশা করছি, অন্য বছরের চেয়ে এবার অনেক লোক বেশি হবে। মাঝে তো দুই বছর ইজতেমা হয়নি। যে কারণে ইজতেমায় আসতে মানুষের মধ্যে বেশ উচ্ছ্বাস কাজ করছে। এক্ষেত্রে মানুষের মনের আবেগটাই বেশি কাজ করছে।
কুমিল্লার বরুড়া থেকে জামাত নিয়ে ইজতেমায় এসেছেন মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন, পরে আসলে ভেতরে জায়গা পাব না, তাই দুই দিন আগেই চলে এসেছি। আমরাই যে আগে এসেছি তা নয়, আরও এক সপ্তাহ আগে থেকেই মানুষ আসতে শুরু করেছে। মাহমুদুল আরও বলেন, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ মানুষ এখানে এসেছে, একই পরিমাণ মানুষ রাস্তায় আছে। তারাও এখানে আসবে। অন্যান্য বারের চেয়ে মনে হচ্ছে মানুষের উপস্থিতি দ্বিগুণ হবে। ইজতেমায় স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন সময়েই আমরা ইজতেমায় আসি। কিন্তু এবার মানুষের স্রোত দেখে মনে হচ্ছে অন্যান্য সময়ের তুলনায় মানুষ দ্বিগুণ হবে।
মুসল্লিদের আগমনের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরাও দোকানপাট নিয়ে বসেছে। জমে উঠছে বিকিকিনি। ইজতেমা মাঠের পাশেই খোলা জায়গায় সারিবদ্ধভাবে বসেছে নানা দোকানপাট। তসবিহ, জায়নামাজ, আতর, টুপি থেকে শুরু করে আছে শীত নিবারণের নানা গরম কাপড়ও। এবারের আয়োজন প্রায় এক বর্গকিলোমিটারের বিশাল মাঠটিতে বাঁশের খুঁটির ওপর চটের ছাউনির প্যান্ডেলে লাগানো হয়েছে বিশেষ ছাতা মাইক। বসানো হয়েছে পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক বাতি। দেশীয় তাবলীগের মুসল্লিদের জন্য জেলাওয়ারি আলাদা ৯১ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এক বাণীতে বলেছেন, ইজতেমা ইসলামের সুমহান আদর্শ জানা, বোঝা ও আমলের পথ সুগম করবে। তিনি বিশ্ব ইজতেমা ২০২৩ উপলক্ষে ইজতেমায় অংশ নেয়া বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসল্লিদের স্বাগত জানান।
তিনি বলেন, ইসলাম শান্তি ও মানবতার ধর্ম। ইসলামের সুমহান আদর্শ ও আকিদাকে অনুসরণের পাশাপাশি এর প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে বিশ্ব ইজতেমায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মুসল্লিদের অংশগ্রহণ এক মহতী উদ্যোগ। তিনি আরও বলেন, বিশ্ব ইজতেমা ইসলামি উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় করতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ব ইজতেমা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুক— এ প্রার্থনা করে তিনি বলেন, ‘মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন’।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপর এক বাণীতে বলেছেন, ইজতেমা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য, সমপ্রীতি, সৌহার্দ্যের এক অপূর্ব মিলনক্ষেত্র, যা ইসলামি সমাজ, শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব ও মহানুভবতার এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। গতকাল শুক্রবার ‘বিশ্ব ইজতেমা’ উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আবহমানকাল ধরে আমাদের লালিত অসামপ্রদায়িক চেতনা, অকৃত্রিম সরলতা ও অতিথি পরায়ণতা এবং সহিষ্ণুতার আলোকবার্তা ইজতেমায় আগত বিদেশি মেহমানদের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে যাবে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আলমগীর মিয়া জানান, আগত মুসল্লিদের জন্য ৩১টি টয়লেট বিল্ডিংয়ে এক সঙ্গে ৯ হাজার মুসল্লি তাদের প্রস্রাব-পায়খানার কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। বিআরটিসি এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে ইজতেমার মুসল্লিদের আনা নেয়ায় বিশেষ বাস-ট্রেন সার্ভিসের ব্যবস্থা নিয়েছে। ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম পাশে তুরাগ নদীর উপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাঁচটি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছে মুসল্লিদের পারাপার হওয়ার জন্য।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুই পর্বে পোশাকে, সাদা পোশাকে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবেন ১০ সহস্রাধিক সদস্য।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুুলিশ বিভাগ ১৪টি কন্ট্রোল রুম তৈরি করেছে। র্যাবের কন্ট্রোল রুম থাকবে, ডিএমপি তার এলাকায় কন্ট্রোল রুম খুলেছে, ওয়াচ টাওয়ার, রুটটফ ডিউটিসহ সিআইডি, নৌপুলিশ, অবজারভারভেশন টিম থাকবে, র্যাবের হেলিকপ্টার টহল থাকবে। ডগ স্কোয়াড টিম, মোবাইল পেট্রোল টিম, বোম ডিস্পোজাল টিম থাকবে। ১০ হাজারেরও বেশি পুলিশ আনসার, র্যাব সদস্য পোশাক এবং সাদা পোশাকে ইজতেমার ভেতর বাহিরসহ টঙ্গী-উত্তরার পুরো এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করবেন।
মুসল্লিদের অংশগ্রহণ অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ : বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম দিন গতকাল শুক্রবার হওয়ায় ইজতেমা মাঠে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জুমার নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে জুমার জামাত শুরু হয়। নামাজের ইমামতি করেন বাংলাদেশের মাওলানা জোবায়ের। ইজতেমায় যোগদানকারী মুসল্লি ছাড়াও জুমার নামাজে অংশ নিতে রাজধানী ঢাকা-গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকার লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমাস্থলে হাজির হন।
তুলনামূলক কম মুসল্লি এবার বেনাপোলে : এবারের ইজতেমায় যোগ দিতে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে গত কয়েক বছরের তুলনায় কম সংখ্যক বিদেশি বাংলাদেশে আসছেন বলে জানা গেছে। গত কয়েক মৌসুমে এই চেকপোস্ট দিয়ে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার বিদেশি মুসল্লি বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে আসতেন। কিন্তু চলতি বিশ্ব ইজতেমায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাত্র ৪০০ ভারতীয় মুসল্লি এসেছেন বলে ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে।
পরিদর্শনে ডিএমপি কমিশনার : বিভিন্ন দেশের অতিথিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লক্ষাধিক মানুষ সমবেত হওয়া ইজতেমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পুলিশ কন্ট্রোল রুম গতকাল পরিদর্শন করেছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
পত্রিকা-পলিথিন ১০ টাকা, অজুর পানি ২০ : ইজতেমা ঘিরে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জমজমাট ব্যবসা শুরু হয়েছে। ইজতেমা মাঠের বাইরে দেশের বৃহৎ জুমায় অংশ নিতে আসা মুসল্লিদের কাছে অজুর পানি ২০ টাকা, পুরোনো পত্রিকা ও নামাজের জন্য পলিথিন ১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে গতকাল।
মেট্রোতে চড়ে ইজতেমায় মুসল্লিরা : এবারের ইজতেমার প্রথম পর্বে যানজট এড়াতে গতকাল মেট্রোরেল ব্যবহার করে উত্তরা পর্যন্ত গিয়েছেন মুসুল্লিরা।
ইজতেমা মাঠে দুই মুসল্লির মৃত্যু : গতকাল শুক্রবার ইজতেমা ময়দানে গাজীপুর শহরের ভুরুলিয়া এলাকার বাসিন্দা আবু তৈয়ব ওরফে আবু তালেব (৯০) এবং সিলেটের জৈন্তাপুর থানার হরিপুরের হেমুবটপাড়া এলাকার নুরুল হক (৬৩) নামের দুই মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, দুজনই বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে আবু তৈয়ব তাবলীগ জামায়াতের গাজীপুর মারকাজের শূরা সদস্য।
এক দিনে ৪৩৮ মুসল্লিকে চিকিৎসাসেবা : ইজতেমা ময়দানে প্রচণ্ড শীতসহ নানা কারণে অসুস্থ হয়ে যাওয়া বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের জন্য জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে ফ্রি চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের হোন্ডা গেট ক্যাম্প, বাটা গেট ক্যাম্প ও আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৩৮ জনকে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়েছে।