- বেড়েই চলেছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগনির্ভরতা প্রশাসনে অসন্তোষ-অন্তর্দ্বন্দ্ব
- ৫২ বছরেও হয়নি চুক্তিতে নিয়োগের নীতিমালা
- প্রাধান্য পাচ্ছেন সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তারা
- আইজিপিসহ বিভিন্ন বড় পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মাপকাঠি অনুসরণের পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের
বারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে দুর্নীতির পরিমাণ বাড়ে, এমনকি কর্মকর্তাদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব গড়ে ওঠে —আবদুল আউয়াল মজুমদার, সাবেক সচিব
পুলিশে অতীতে না থাকলেও সরকার চাইলে দিতে পারে, তবে এতে বাহিনীর কারো কারো অসন্তোষও থাকতে পারে —মোখলেছুর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে যে হারে বর্তমান সময়ে নিয়োগনির্ভরতা বেড়েছে, অতীতে সে হারে ছিল না। সাংবিধানিক ভিত্তির কথা বলা হলেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালাবিহীন নিয়োগের এই প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের যোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে চরম অসন্তোষ। প্রশাসনিক কার্যক্রমেও পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। তবুও দিনে দিনে বেড়েই চলেছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ।
অথচ দেশ স্বাধীনের ৫২ বছরেও এ নিয়ে এখনো হয়নি কোনো নীতিমালা। বরং সরকারের আস্থাভাজন ও পছন্দের কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দিয়েই চলছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। বলাবলি হচ্ছে, দেশে কী যোগ্য লোকের সংকট দেখা দিয়েছে? নতুবা একই ব্যক্তিকে কেন এক বা একাধিকবার ‘এক্সটেনশন’ করতে হচ্ছে। অতীতে কেবল দক্ষ কর্মকর্তার সংকটে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এমন নিয়োগ হতো। এতে সমালোচনাও ছিল কম।
সম্প্রতি ছয়-ছয়বার এক্সটেনশন করা কর্মকর্তা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি বাড়ির তথ্য ফাঁসের পরই মূলত সৃষ্টি হয় সমালোচনা। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া। সমসাময়িক সময়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ প্রধান পদেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। যে নিয়োগ দেশের ইতিহাসে প্রথম। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদেও টানা দুবার এক্সটেনশনের ঘটনা ঘটেছে। যদিও অতীতে এ পদে এক দফা এক্সটেনশনের নজির রয়েছে।
যে কারণে বিভিন্ন মহল থেকেই এখন প্রশ্ন উঠছে, বিশেষ কি দক্ষতা কিংবা অর্জনের জন্য কারো কারো ক্ষেত্রে একাধিকবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ঝুঁকছে সরকার। যেখানে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব তো পড়েই; আবার নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যেও কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের প্রকাশ পায়। অনেক সময় দুর্নীতিতেও জড়িয়ে পড়েন তারা। যেটা তাকসিম এ খানের ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
প্রশাসনের কর্মকর্তারাও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরুদ্ধে। তবে বিভিন্ন পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার সংবাদকে জানান, যেখানে যোগ্য লোকের সংকট রয়েছে, সেখানে সরকার চাইলে এক্সটেনশন করতেই পারে। সাধারণত সব দপ্তরেই সমসাময়িক একাধিক দক্ষ কর্মকর্তা থাকেন।
দক্ষ কর্মকর্তার সংকট তেমন নেই। এক্ষেত্রে তাদের মূল্যায়ন না করেই এলপিআরে যাওয়া সরকারের পছন্দের কর্মকর্তাদের এক্সটেনশন করা হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কিংবা সার্বিকভাবে প্রশাসনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কর্মকর্তাদের অনেকেই বলছেন, অতীতের সব এক্সটেনশনের ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ছিল। তাই প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে বিভিন্ন পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, নতুন বছরে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলেও প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিশেষ করে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে অনেকেই অসন্তোষ নিয়ে কাজ করছেন। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল বা মহার্ঘ ভাতা দেয়ার কোনো পরিকল্পনা এ মুহূর্তে সরকারের নেই। এর ফলে নতুন করে আর সরকারি কর্মচারীদের বেতনও বাড়ছে না। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশাসনেও আলোচনা চলছে।
এর মধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের গুঞ্জন তো রয়েছেই। প্রশাসনের অনেক সিনিয়র ও দক্ষ কর্মকর্তা কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে হারিয়ে ফেলছেন কাজের স্বাভাবিক গতি ও আগ্রহ। অথচ অনেকেই তদবির-আশীর্বাদের ছোঁয়ায় অবসরের পরও একই পদে পাচ্ছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। তাও আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিকবার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চুক্তি ও বৈদেশিক নিয়োগ শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার সংবাদকে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সরকারের চলমান প্রক্রিয়ারই অংশ। এ প্রক্রিয়ায় চলতি বছর চার থেকে পাঁচজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এদিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ শুধু দেশেই নয়, বিদেশি মিশনগুলোতেও হচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বিদেশেও বাংলাদেশ মিশনগুলোতে বর্তমানে ১৪ জন কূটনীতিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কর্মরত। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ১০ জন রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার, দুজন মিনিস্টার, একজন কাউন্সিলর এবং একজন তৃতীয় সচিব রয়েছেন।
বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি সময়ের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার। দেশ স্বাধীনের পর গত ৫২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে একটি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। টানা ছয় বছর তিনি মন্ত্রণালয়টিতে ছিলেন। তার মধ্যে পাঁচ বছরই চুক্তিভিত্তিক। মন্ত্রণালয়টির শীর্ষ পদে এতটা সময় আর কেউ ছিলেন না।
সাবেক এ গণপূর্ত সচিব মোট তিনবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর চাকরির মেয়াদ শেষে শহীদ উল্লা খন্দকারের অবসর-উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকার তার পিআরএল বাতিল করে দুবছরের জন্য চুক্তিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সেই চুক্তির মেয়াদ আবারও দুই বছর বাড়ানো হয়। ২০২১ সালে আবার সেই চুক্তির মেয়াদ বাড়ে এক বছর। সে হিসেবে তার সর্বশেষ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর শেষ হয়।
২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর সেতু বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর তার অবসর-উত্তর ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল। তবে ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর তাকে এক বছরের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
পরের বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে আরও দুই বছরের জন্য বাড়ানো হয় চুক্তির মেয়াদ। অবশেষে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর অবসরে যান খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারকে। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর তাকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। দায়িত্ব নেয়ার ১৯ দিনের মাথায় চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি তাকে অবসরে পাঠায় সরকার। তার স্থলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেনকে। প্রশাসনের অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন অতীতের মতোই এবারও বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মেয়াদ বাড়ানো হবে।
কারণ, এর আগের মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ও শফিউল আলমের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। তবে তা আর হয়নি। কবির বিন আনোয়ারের মতো এত কম সময়ের জন্য এর আগে কেউ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেননি। এর আগে ২০০২ সালে এক মাস চার দিন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী। ২০০৬ সালে তিন মাস তিন দিনের জন্য দায়িত্বে ছিলেন আবু সোলায়মান চৌধুরী। সব মিলিয়ে দেশের ইতিহাসে প্রশাসনের শীর্ষ পদে এটিই ছিল সবচেয়ে কম সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন।
এদিকে দেশে প্রথমবারের মতো চুক্তিভিত্তিক আইজিপি নিয়োগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, আইজিপিসহ পুলিশের বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি মাপকাঠি অনুসরণ করা দরকার, যেন পরবর্তীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে না হয়। তারা বলছেন, পুলিশে যারা আইজিপি হতে পারবেন না, তাদের অতিরিক্ত আইজিপি পদে নিয়োগ দেয়া যাবে না।
প্রত্যেক অতিরিক্ত আইজিপিরই আইজিপি হওয়ার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে এবং তাদের মধ্যে যিনি অধিক সিনিয়র, কেবল তাকেই এক দিনের জন্য হলেও আইজিপি নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। আইজিপি ছাড়াও যেসব বড় পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, সেসব কর্মকর্তার কারো বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির গুরুতর তথ্য-প্রমাণ পাওয়া মাত্রই অপসারণ করতে হবে এবং এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ সরকারের হাতে সব সময়ই রয়েছে।
প্রথমবারের মতো চুক্তিভিত্তিক আইজিপি নিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশ পুলিশে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অতীতে না থাকলেও সরকার যদি প্রয়োজন মনে করে, তাহলে সেক্ষেত্রে দিতেই পারে। আমি এটাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি না। তবে পুলিশ ডিপার্টমেন্টটাই এমন যে, এ নিয়ে কারো কারো মনে অসন্তোষও থাকতে পারে। কিন্তু এর বহিঃপ্রকাশ হওয়ার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। যেহেতু এ প্রক্রিয়াটির সাংবিধানিক ভিত্তি রয়েছে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, যেগুলো সরকারি চাকরির অর্গানোগ্রামের পথ, সেগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া সমীচীন নয়। কারণ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে প্রশাসনে যারা পদোন্নতির যোগ্য, তাদের প্রতি অবিচার করা হয়। তাদের মনোবল ভাঙে এবং কাজের স্পৃহাও কমে যায়। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যেমন আমি যোগ্যতা অর্জন করে বসে আছি, আমাকে নিয়োগ দেয়া হলো না। কিন্তু যারা পাওনা নন, তাদের দেয়া হলো।
চুক্তিভিত্তিক চাকরি তো কারো পাওনা নয়। পদ খালি থাকলে পদোন্নতি পাওয়া আমার পাওনা। এ কারণে চুক্তিভিত্তিক দেয়াটা উচিত নয়। তিনি বলেন, চুক্তি ভত্তিক নিয়োগ দিলে সৎ ও যোগ্যদেরই দেয়া উচিত। কিন্তু যাদের নামে দুর্নাম আছে, যারা যোগ্য নন, তাদের নিয়োগ দেয়া উচিত নয়। বরং তাদের দুর্নীতিগুলো তদন্ত হওয়া উচিত। যারা বারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান, তাদের দুর্নীতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করেন। যেমন, ওয়াসার এমডি তাকসিমের দ্বারা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে— এমন কথা শোনা যাচ্ছে। মিডিয়ায়ও লেখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে অধস্তনরা বঞ্চিত হন। তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকবে, তাদের এই পদে রাখা উচিত নয়। দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকলে তারা কর্তৃত্ববাদী হয়ে যান।
টিএইচ