- নোম্যান্সল্যান্ডের আইন ভেঙে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা সংঘর্ষে
- একজন নিহত, শিশুসহ দুজন গুলিবিদ্ধ, ক্যাম্প ছাড়ছে রোহিঙ্গারা শিবিরের ৬২১ পরিবারের মধ্যে ৫০০ ঘর পুড়ে ছাই
- নিহত রোহিঙ্গা জঙ্গির গায়ে মিলল আরএসওর পোশাক
- শূন্যরেখায় রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করতেই শিবিরে আগুন
- এম-১৬ ও একে-৪৭-এর মতো অস্ত্র ব্যবহার করছে রোহিঙ্গারা
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের মধ্য গোলাগুলি হচ্ছে -ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি জেলা প্রশাসক, বান্দরবান
শূন্যরেখায় আন্তর্জাতিক আইনে আমাদের হস্তক্ষেপের এখতিয়ার নেই -রোমেন শর্মা; ইউএনও, নাইক্ষ্যংছড়ি
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে নোম্যান্স ল্যান্ডে (শূন্যরেখায়) আবারও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। ক্যাম্প ছাড়ছে রোহিঙ্গারা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত সীমান্তে শূন্যরেখায় গোলাগুলি চলেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এর আগে গত বুধবার সকাল থেকে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে দিনভর থেমে থেমে গোলাগুলির পর সন্ধ্যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগে। শূন্যরেখার মিয়ানমার অংশে দিনভর ওই গোলাগুলির ঘটনায় এমএসএফের হাসপাতাল থেকে এক রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া ১২ বছরের এক শিশুসহ আরও দুজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন ওই হাসপাতালে। শূন্যরেখা রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন লাগায় নারী ও শিশুসহ ৩০ জনের মতো রোহিঙ্গা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদে আশ্রয় নিয়েছেন। পরে তাদের উদ্ধার করে তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যায় স্থানীয়রা। এতে রোহিঙ্গাসহ সীমান্তের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন। গোলাগুলির ঘটনায় সীমান্তে বসবাসরত অনেকে গৃহপালিত পশুসহ অন্যত্র সরে যান।
তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকালেও এখানে গোলাগুলি হয়েছে। আগুনে আমাদের শিবিরের ৬২১টি পরিবারের মধ্যে প্রায় ৫০০ ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এসব পরিবারের অধিকাংশ মিয়ানমার সীমানার ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে। কিছু পরিবার বাংলাদেশেও আশ্রয় নিয়েছে। শূন্যরেখা থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করতেই একটি সশস্ত্র গ্রুপ আশ্রয় শিবিরে আগুন দেয়।’
নিহত ব্যক্তি বালুখালী ক্যাম্পের হামিদ উল্লাহ ও আহতরা হলেন টেকনাফের জাদিমুড়া ক্যাম্প ২৬-এর মুহিব উল্লাহ ও ঘুমধুম জিরো পয়েন্টের শিশু মো. হোসেন। গণমাধ্যমের কাছে আসা ছবিতে নিহতের গায়ে আরএসও নামে এক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পোশাক দেখা গেছে। তুমব্রু শূন্যরেখায় স্থাপিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২০১৭ সালের পর থেকে চার হাজার ২৮০ জন রোহিঙ্গা বসবাস করছিলেন। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে এই সীমান্তে মিয়ানমার অংশে দেশটির সেনাবাহিনী এবং স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে প্রায় দুই সপ্তাহব্যাপী সংঘর্ষ চলে। ওই সংঘর্ষে মিয়ানমার অংশ থেকে মর্টার শেল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়ে। ওই সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কয়েক দফা প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মর্টারশেল পড়ায় মিয়ানমারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়।
তারা জানায়, ভুলবশত মর্টারশেল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়েছিল। এর রেশ না কাটতেই গত দুদিন থেকে আবারও সংঘর্ষ চলছে।
সীমান্তের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সীমান্তের কোনারপাড়া শূন্যরেখা রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় মিয়ানমারের দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে বৃহস্পতিবার সকালেও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। একপর্যায়ে শিবিরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, আধিপত্য বিস্তারে নিজেদের শক্তি বাড়াতে প্রতিযোগিতা করে অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করছে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে ছদ্মবেশে থাকা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের অত্যাধুনিক এম-১৬ ও একে-৪৭-এর মতো অস্ত্রের পর অত্যাধুনিক গ্রেনেড ব্যবহার নিয়ে চিন্তিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নেতাদের। ক্যাম্পে গত চার মাসে ২৩ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা। এ ছাড়াও গেল চার মাসে শুধু উখিয়া থেকে ৩৭ জনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। অপহৃত বেশির ভাগ স্থানীয় বাসিন্দা। ড্রোন ক্যামেরা ও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। এতেও কিছু হচ্ছে না। গত পাঁচ বছরে ১৩৫ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। মামলা হয়েছে পাঁচ হাজার ২২৯টি। রোহিঙ্গারা শুধু এখন নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি নয়, রোহিঙ্গাদের হামলায় কয়েকজন বাংলাদেশিও নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি অপহরণের শিকারও হচ্ছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গা হলো, উখিয়া ও টেকনাফে এখন রোহিঙ্গারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশিরা সেখানে এখন সংখ্যালঘু। সে কারণেই শরণার্থী ক্যাম্পের পরিস্থিতি কতদিন নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে সে উদ্বেগ রয়েই। যাচ্ছে স্থানীয়দের মধ্যে।
বাংলাদেশের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে জানিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা বলেন, ‘শূন্যরেখা হওয়ায় আন্তর্জাতিক আইনে আমাদের হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার নেই। তবে শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা শিবিরে অধিকাংশ বসতঘর পুড়ে গেছে বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনেছি।’
কক্সবাজারের উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, ঘটনার পর দুপুরে উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতাল থেকে গুলিবিদ্ধ তিন জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। নিহত রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। বাকি দুজন চিকিৎসাধীন।
বিষয়টি স্বীকার করে বান্দরবান জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, `ঘুমধুম তুমক সীমান্তে শূন্যরেখায় মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের মধ্য গোলাগুলি চলছে। সীমান্তে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। আমরা চোখ রাখছি। তবে এখানে আন্তর্জাতিক কিছু নিয়ম রয়েছে, তাই আমাদের কিছুই করার নেই।