- ১৩ বছরে গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪০০ শতাংশ
- বিদ্যুতে বেড়েছে ১০ বার
- ব্যবসায়ীদের উষ্মা প্রকাশ
- বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম
তীব্র সংকটের মধ্যেই রেকর্ড দাম বাড়ানো হয় এবার গ্যাসে। চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ না থাকায় শিল্পের চাকার গতি নিম্নমুখী। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে উল্লম্ফন গতিতে। এতে খরচের জাঁতাকলে পড়বে জনগণ। এবার এক লাফে রেকর্ড ৮২.১০ শতাংশ দাম বেড়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের। এর আগে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুরেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাস- বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করছিল। তবে এই প্রথম নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ভোক্তা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাহী আদেশে দাম বৃদ্ধির ফলে ভোক্তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, অর্ডারের অভাবে রপ্তানিমুখী শিল্প কঠিন সময় পার করছে। এ মুহূর্তে বিদ্যুতের পর বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি শিল্পকে আরও নাজুক অবস্থায় ফেলবে। তাই শিল্পের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে জ্বালানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা উচিত। শুধু গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এদিকে বাসাবাড়ি, পরিবহন এবং সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম এ যাত্রায় বাড়েনি। বেড়েছে বিদ্যুৎ, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার (প্রতি ইউনিট) গ্যাসের গড় খুচরা দর ১১ টাকা ৯০ পয়সা। এটা বেড়ে এখন গড় দাম ঘনমিটারে দাঁড়িয়েছে ২১ টাকা ৬৭ পয়সা। বেড়েছে ৮২.১০ শতাংশ। এটা রেকর্ড দাম বৃদ্ধি। ২০০৯ সালে প্রতি ঘনমিটারের গড় দাম ছিল চার টাকা ৩৪ পয়সা। তখন থেকে এ পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে ছয়বার গ্যাসের দাম বেড়েছে। গত সাড়ে ১৩ বছরে এই বৃদ্ধির হার ৪০০ শতাংশ। এর মধ্যে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে গড়ে ১১.২২ শতাংশ, ২০১৫ সালের ১ আগস্ট ২৬.২৯, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২২.৭০, ২০১৯ সালের ১ জুলাইয়ে ৩২.০৮ এবং ২০২২ সালের ৫ জুন ২২.৭৮ শতাংশ বাড়ে গ্যাসের দাম। ফলে সব নিত্যপণ্যের দাম একযোগে বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ পটভূমিতে আরেক দফা খরচের জাঁতাকলে পড়তে যাচ্ছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিদ্যুতের মতো এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। নতুন দাম ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। আর বিদ্যুতে নতুন দাম ঘোষণার দুই সপ্তাহ আগ থেকেই কার্যকর হয়েছে। সাত মাসের ব্যবধানে আবার গ্যাসের দাম বাড়ায় অসংখ্য শিল্প-কারখানা বন্ধ হবে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলেন, আমরা গ্যাসে প্রতি ইউনিটের দাম ২৫ টাকা করার জন্য সম্মতি দিয়েছি। তবে তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ টাকা। বাকি পাঁচ টাকা সরকারকে সমন্বয় করার অনুরোধ জানান তিনি। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের জন্য বেশি দাম দিতে চাইলেও দাম এতটা বাড়বে, তা ভাবেননি ব্যবসায়ীরা। আইন সংশোধন করে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রথম ধাপেই এক লাফে গ্যাসের দাম কিছু ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৭৮ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা। দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে ভর্তুকির চাপ থেকে বেরিয়ে আসা এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার যে যুক্তি সরকার দিচ্ছে, তার যথার্থতা স্বীকার করলেও এক ধাপে এতটা বৃদ্ধি মানতে পারছেন না গ্রাহকরা। শিল্প ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও তার প্রভাবে পণ্যমূল্য বেড়ে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের সংকট আরও বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বলছে, অযৌক্তিকভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করে সেই ব্যয়কে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে দামটা বাড়ানো হচ্ছে। দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও এখানে অকার্যকর। পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, কারখানাগুলোতে কাজ কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে এটা মূল্য বৃদ্ধির সঠিক সময় নয়। আমরা ২২ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর কথা মেনে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ১৬ টাকা থেকে এভাবে ৩০ টাকা করে ফেলার ইতিহাস আর আছে নাকি? এর আগে তেলের দাম বাড়ল, তারপর গ্যাসের দাম বাড়ল; এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ল। এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়ল। এভাবে বাড়তে থাকলে যে উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে, তা দিয়ে ক্রেতারা পণ্য নেবে নাকি?
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে। অন্যদের না বাড়িয়ে কেবল শিল্প খাতে দাম বাড়াতে গিয়ে শিল্পের ওপর প্রভাব বেশি পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে এভাবে ২০০ শতাংশ মেনে নেয়া যায় না। বাড়ানোটা সহনীয় হতে হবে। ভ্যাট- ট্যাক্স কমালেও ইউনিটপ্রতি দাম ২০ টাকার মধ্যে রাখা যেত।
ক্যাবের সহসভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম মনে করেন, জ্বালানি- সংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে বেড়ে যাওয়া ব্যয়ের ভার জনগণের ওপর চাপাতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভোক্তার অধিকার রক্ষায় সরব এই অধ্যাপক মনে করেন, মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করার আগে ব্যয়বৃদ্ধির অন্যায্য উদ্যোগগুলো প্রতিরোধে আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, মূল্যবৃদ্ধি হলে আমরা চিৎকার করছি। এটা একটা বিভ্রান্তিকর বিষয়। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে হবে, নাকি ব্যয় বৃদ্ধি ঠেকাতে হবে— সেটা এখন আলোচনার বিষয়।
হতাশা প্রকাশ করে অধ্যাপক শামসুল বলেন, ব্যয়ের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অসংগতির কথা তুলে ধরলেও কেউ আমলে নিচ্ছে না। ব্যয় বৃদ্ধি করে লোকসান দেখাচ্ছে। সেই লস পূরণ করতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছিল, এখন দেবে না। এখন দাম বৃদ্ধির খাঁড়া সরাসরি যাবে জনগণের ওপর। এলএনজি আমদানি, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ব্যয়, দেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক গ্যাস উত্তোলন প্রতিষ্ঠানগুলো (আইওসি), দেশীয় কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়, ভ্যাট-ট্যাক্স, কোম্পানিগুলোর মুনাফা, সঞ্চালন, অবকাঠামো নির্মাণ হতে শুরু করে পুরো সরবরাহ প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে বলে দাবি করেন ক্যাবের উপদেষ্টা। কতটা ব্যয় হওয়া যৌক্তিক আর কতটা অযৌক্তিক, কতটা বেশি মুনাফা করা হচ্ছে, যৌক্তিক রাজস্বের চেয়েও সরকার কতটা বেশি রাজস্ব নিচ্ছে- এসব বিশ্লেষণ করে এই অন্যায় ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যেটাকে প্রতিযোগিতা আইনের ভাষায় লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধি বলা হয়, সেটা বন্ধ করার জন্য এখন ভোক্তা আন্দোলনের বিকল্প নেই। এগুলো দেখভালের জন্য জ্বালানি বিভাগ, প্রতিযোগিতা কমিশন, রেগুলেটরি কমিশন থাকলেও সেগুলোকে এখন `সম্পূর্ণ অকার্যকর` বলে মনে করেন তিনি। ক্যাবের পক্ষ থেকে গত দুই যুগ ধরে বলে আসছি যে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত সর্বনাশার দিকে যাচ্ছে। এখন শিল্প গ্রাহক-বাণিজ্যিক গ্রাহকদের যদি হুঁশ হয়, তারা যদি প্রতিরোধ করে এগিয়ে আসে, তাহলেই কিছু হবে।