- দুর্ঘটনা নয় হতাহতের সংখ্যা কমানো নিয়েই চলে তেলেসমাতি কাণ্ড
- ঢাকাসহ চার জেলায় নিহত সাত
- সরকারি হিসাবে কমছে, বেসরকারি সংগঠনের হিসাবে বাড়ছে দুর্ঘটনা-মৃত্যু
- গত বছর সড়কে নিহতদের ৮১ শতাংশই কর্মক্ষম, মানবসম্পদের আর্থিক ক্ষতির মূল্য ১৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি
-রোড সেফটি ফাউন্ডেশন
সড়ক খাতে শৃঙ্খলা আনতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে
-অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন। পরিচালক, সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বুয়েট
নিরাপদ সড়কের জন্য চার বছর আগে ২০১৮ সালে দেশ কাঁপানো আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। সে সময় দুর্ঘটনা কমানোর বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘরে ফিরানো হয় শিক্ষার্থীদের। কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি আদৌ।
দুর্ঘটনায় আহত-নিহত হয়েছেন এমন মানুষদের স্বজনরা বলছেন, সরকার সে সময় এত প্রতিশ্রুতি দিলেও রাস্তায় মৃত্যু কমেনি; বরং বাড়ছেই। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা কমানো নিয়ে যত আলোচনা, পরামর্শ, তর্কবিতর্ক-এর প্রায় সবটাই রাজধানীকেন্দ্রিক। ঢাকায় বসেই দুর্ঘটনা কমানোর নানা প্রতিশ্রুতি দেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা। অথচ ঢাকায়ও দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমার বদলে বাড়ছেই। গত বছর সারা দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ২৭ শতাংশই হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এমনকি দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকার সড়কেই দুর্ঘটনা ও মৃত্যু-দুটিই এখন সর্বোচ্চ। সারা দেশে দুর্ঘটনার তথ্য নিয়েও আবার রয়েছে তেলেসমাতি কাণ্ড। বেসরকারি সংগঠনগুলোর হিসাবে ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বাড়লেও সরকারি হিসাবে তা কমেছে।
পুলিশের বরাতে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, ২০২২ সালে পাঁচ হাজার ২০০ দুর্ঘটনায় চার হাজার ৬৩৮ জন নিহত হয়েছেন। আগের বছরে পাঁচ হাজার ৪৭২ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে পাঁচ হাজার ৮৪ জনের। ২০২১ সালের চেয়ে সড়কে মৃত্যু প্রায় ৯ শতাংশ কমেছে! যদিও বেসরকারি সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনে ২০২১ সালের তুলনায় দুর্ঘটনা ও মৃত্যু প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়েছে বলে জানা যায়।
সম্প্রতি বিআরটিএর এক কর্মশালা সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বেসরকারি সংগঠনের এসব প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এসব প্রতিবেদন বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এ বছরের প্রথম সপ্তাহে যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, ২০২২ সালে সড়কে ছয় হাজার ৭৪৯ দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগের বছরের তুলনায় ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং মৃত্যু ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, ২০২২ সালে সাত হাজার ৭১৩ জনের প্রাণ গেছে সড়কে। আগের বছরে এই সংখ্যা ছিল ছয় হাজার ২৮৪। ২২ শতাংশ প্রাণহানি বেড়েছে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) জানায়, আট হাজার ১০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ২০২২ সালে; যা ২০২১ সালের তুলনায় তিন হাজার ১৩৪ জন বেশি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, গত বছর সড়কে শুধু শিক্ষার্থীই মারা গেছে এক হাজার ২৩৭ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় ডিসেম্বরে। আর সংখ্যার দিক থেকে তুলনামূলক কম মৃত্যুর ঘটনা এপ্রিলে ৬৩ জন। 2022 সালের মে জুলাই, অক্টোবর ও ডিসেম্বর— এই চার মাসের প্রতি মাসেই শতাধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় সড়কে।
এর মধ্যে মে মাসে ১০৭ জন, জুলাইতে ১০৪ জন ও অক্টোবরে ১২৩ শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আর গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন সাত হাজার ৭১৩ জন। অর্থাৎ মোট নিহতের ১৬ শতাংশের বেশি ছিল শিক্ষার্থী। এদের বড় অংশের মৃত্যু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হলেও গতকালও রাজধানীর কুড়িলে ভিক্টর পরিবহনের চাপায় মারা গেছে নর্দান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নাদিয়া। ঢাকার বাইরেও দুর্ঘটনা ঘটেছে গতকাল। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মনসুরাবাদ এলাকায় স্টার লাইনের বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-মেয়েসহ তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। জামালপুরের সরিসাবাড়ীতেও ট্রাকচাপায় নিহত হয় একজন। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বাসচাপায় নিহত হন একজন। নাটোরের লালপুরে সিএনজি দুর্ঘটনায় নিহত হন আরেকজন।
এসব দুর্ঘটনা নিয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিরাপদ করার কথা সরকার মুখে যেভাবে বলছে, বাস্তবে সেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের উদ্যোগে উদাসীনতা দেখা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কী করণীয়, তা সরকারের অজানা নয়। কিন্তু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়নে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী নয়। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সি কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৮১ শতাংশ।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতরা তাদের পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে এসব পরিবার আর্থিকভাবেও সংকটে পড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে যে মানবসম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, এর আর্থিক মূল্য ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় নিহত হন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। তার বাবা শাহ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, সরকার এত প্রতিশ্রুততি দিলো, রাস্তায় মৃত্যু কমল না। এটি মানা যায় না। নিরাপদ সড়ক দাবিতে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত রাজপথে আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের ফলে নতুন সড়ক পরিবহন আইন হয়। এরপরও পরিস্থিতির পরিবর্তন না হওয়ায় গত বছরও নিরাপদ সড়ক দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে।
এদিকে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে, তার হিসাব তৈরি করেছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট-এআরআই। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা।
আর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। নিরাপদ সড়ক চাই এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। প্রায় ২৭ শতাংশ দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা বিভাগে।
রোড সেফটির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে এক হাজার ৮৪১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে দুই হাজার ৪৪ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু চট্টগ্রাম বিভাগে। আর সবচেয়ে কম মৃত্যু হয়েছে সিলেট বিভাগে। ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা বেশি হওয়ার বড় কারণ এখানে যানবাহনের চলাচলও বেশি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৫৬ লাখ। এর মধ্যে মোটরসাইকেলই ৪০ লাখের বেশি। নিরাপদ সড়ক চাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, একক জেলা হিসেবে ঢাকায় সর্বোচ্চ গত বছর ৪৫৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮৯১ জন। চট্টগ্রাম জেলায় ৩১০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৪৭ জন। ঢাকা বিভাগের শরীয়তপুর জেলায় সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে। শরীয়তপুরে ২১টি দুর্ঘটনায় ৩৯ জন নিহত হয়েছেন।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের যাতায়াতের মহাসড়কগুলোয় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেশি ঘটেছে। নিরাপদ সড়ক চাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা- চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-আরিচা ও ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়কে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪৪ জন নিহত (গত বছর) হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে সবার আগে দরকার সঠিক তথ্য। কিন্তু সরকারের কাছে সঠিক তথ্যই নেই। গণমাধ্যমে সব দুর্ঘটনার খবর আসে না। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবরের বাইরেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, যেগুলো নথিভুক্ত হয় না। অনেক পঙ্গুত্বের খবর চাপা পড়ে থাকে। দুর্ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা ও হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের সড়ক দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর প্রাণহানি হয় ২৫ হাজার মানুষের। সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর বিশ্লেষণ অনুসারে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের শিকার ব্যক্তিদের বড় অংশই বয়সে তরুণ, শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনা বদলাতে উদ্যোগ না নেয়া হলে এই বিশৃঙ্খলা থেকে বের হওয়া যাবে না। শৃঙ্খলা শুধু টাকাপয়সার বিষয় নয়, সুশাসনের বিষয়। সড়ক খাতে শৃঙ্খলা আনতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।