- উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪৫৫ আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনের ২০৬টি বিকল
- সচল মেশিন বিকল হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণ অবহেলা ও লোকবলের অভাবে
- তৃণমূলে রোগ নির্ণয়ে সাধারণ মানুষের ভরসা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক
- শত কোটি টাকা বিনিয়োগেও সুফল মিলছে না সরকারের জনবান্ধব উদ্যোগের
- প্রান্তিক চিকিৎসকদের দাবি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও মেলে না সমাধান
- উপজেলায় সনোলজিস্টের পদ সৃজন ও নিয়োগ দাবি জনস্বাস্থ্যবিদদের
প্রান্তিকে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সূচনা। আধুনিক চিকিৎসার পূর্বশর্ত রোগ নির্ণয়। কিন্তু লোকবল সংকটে প্রান্তিকে বাড়েনি পরীক্ষা- নিরীক্ষার সুবিধা। রোগ নির্ণয়ে প্রতিটি উপজেলায় বরাদ্দ রয়েছে আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনের। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই সনোলজিস্টের পদ! পদ সৃজন না করে বরাদ্দ দেয়া হয় আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন। মেডিকেল অফিসারের মাধ্যমে কিছু মেশিন জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখা হচ্ছে। দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়ে থেকে বেশির ভাগ মেশিন বিকল হচ্ছে।
আবার অভিযোগ রয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন সচল ও অপারেট করার মতো মেডিকেল অফিসার রয়েছে সেখানেও কমিশনের লোভে রোগীকে ক্লিনিকে পাঠানো হচ্ছে। কোনো কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাস শেষে আল্ট্রাসনোগ্রাম সেবার তথ্য নয়ছয় করে তথ্য দেয়া হচ্ছে। এতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সারা দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪৫৫টি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন রয়েছে। তার মধ্যে ২০৬টি মেশিন বিকল। দীর্ঘদিন ধরে রোগ নির্ণয় সেবা থেকে বঞ্চিত লাখ লাখ মানুষ। নষ্ট হয়েছে প্রায় শত কোটিরও বেশি টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রান্তিকে রোগ নিয়ন্ত্রণে ভরসা এখনো বেসরকারি খাত। ফলে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। জনবল আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কাজে আসছে না মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সরকারের শত কোটি টাকার উদ্যোগ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আল্ট্রাসনোগ্রাম সুবিধা বঞ্চিত হওয়ায় রোগী ও স্বজনরা দায়ী করছেন স্বাস্থ্য প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলাকে।
চিকিৎসকরা বলছেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সনোলজিস্টের পদ নেই জেনেও বছরের পর বছর বরাদ্দ হয় আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন। সনোলজিস্টের পদ সৃজন, প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যন্ত্রপাতি কেনাকাটা আর বরাদ্দেই যেন আগ্রহ বেশি। লোকবল নেই, যন্ত্রপাতি নষ্ট— বিষটি বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো লাভ হয় না। সনোলজিষ্ট না থাকায় বিপাকে পড়তে হয় আমাদের। সাধারণ মানুষ অভিযোগ করে মেশিন থাকার পরও কেন আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হচ্ছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের মধ্যে যেসব মেডিকেল অফিসার অপারেট করতে পারেন কিংবা প্রশিক্ষণ আছে তাদের নিয়মিত ডিউটির ফাঁকে জোড়াতালি দিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে হয়।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, রোগ নির্ণয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম জরুরি একটি পরীক্ষা। জোড়াতালি দিয়ে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব নয়। প্রান্তিকে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সনোলজিস্টের পদ সৃজন ও নিয়োগের বিকল্প নেই। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকে। ২০২০ সালে সরবরাহকৃত যন্ত্রটি কিছু দিন যেতেই অকেজো হয়ে পড়ে। মেরামত করা হলে কয়েকদিন চলে আবার নষ্ট হয়ে যায়। বিষয়টি একাধিকবার কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
রামগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বনময় প্রদ্যার বলেন, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনের সমস্যা থাকায় গত ছয় মাস যাবত আস্ট্রামেশিনের সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। রংপুর কাউনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন থাকলেও নেই প্রশিক্ষিত চিকিৎসক। ফলে বছরের পর বছর আল্ট্রাসনোগ্রাম সেবাবঞ্চিত উপজেলার সেবাগ্রহীতরা। বান্দরবন লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় দুই লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন। হাসপাতালটিতে দুটি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন থাকলেও সনোলজিস্টের অভাবে মেশিন দুটি বন্ধ রয়েছে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ২০১১ সালে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ২০১৭ সালের শেষ দিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে নতুন আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন সরবরাহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জনবলের অভাবে সেটি অদ্যাবধি চালু হয়নি।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. বিধান চন্দ্র দেবনাথ বলেন, জনবল সংকটে আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ৩১ শয্যার শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ২০১২ সালে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। দেয়া হয় আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনসহ রোগী নির্ণয়ের বিভিন্ন মেশিন। হাসপাতালটিতে দুটি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন দীর্ঘদিন থাকলেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও জনবলের অভাবে আজ পর্যন্ত চালু করা সম্ভব হয়নি। দফায় দফায় জনবল চেয়ে চিঠি পাঠিয়েও কোনো কাজ হয়নি। সিলেটের প্রায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবার অবস্থা নাজুক। তড়িঘড়ি করে শয্যা বাড়ানোর নামে অবকাঠামো তৈরি করা হলেও বাড়েনি সেবার পরিধি। শয্যা বাড়লেও লোকবল, যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক তেমন বাড়েনি। হাসপাতালগুলোতে যন্ত্রপাতি অপারেট করার মতো দক্ষ লোকবলের অভাবে যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। বালিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ জন রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ জনের আল্ট্রাসনোগ্রাম সেবা দেয়া হয়। সম্প্রতি হাসপাতালের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আল্ট্রাসনোগ্রাম সেবা চালু করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ৪৩১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪৫৫টি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে ২৪৯টি সচল, অচল ২০৬টি। আবার সচল মেশিন লোকবল না থাকায় অচল হওয়ার পথে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো ঘিরে গড়ে ওঠে ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কতিপয় ব্যক্তির অনৈতিক সখ্য থাকে। এ ছাড়াও ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ব্যবসায় পার্টনারশিপ থাকে কিছু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত একাধিক ব্যক্তির। আবার কোনো কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আল্ট্রাসনোগ্রাম সেবার তথ্য নয়ছয় করা হচ্ছে। মাস শেষে আল্ট্রাসনোগ্রাম সেবার সংখ্যা কম দেখিয়ে অল্প টাকা জমা দেয়া হয়। এসব হিসাবের জন্য করা হয় আলাদা রেজিস্টার। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিস সেন্টারের সংশ্লিষ্ট অনেকের হাত রয়েছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাওয়া রোগ নির্ণয়ের মেশিনপত্র বছরের বছর পর পড়ে থাকলেও সেগুলো স্থাপনে প্রতি মাসে মাঠ পর্যায় থেকে প্রতিবেদন পাঠালেও কোনো ভ্রক্ষেপ নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। মূল্যবান এসব নতুন মেশিনপত্র স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ে পাঠালেও সেগুলো প্রতিস্থাপনে চরম অবহেলা দেখা গেছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের জাতীয় সংগঠন ইউএইচএফপিও ফোরামের সভাপতি ও শরীয়তপুরের জাজিরার ইউএইচএফপিও ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, সনোলজিস্টের পদ নেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু মেশিনের রয়েছে বরাদ্দ। এতে তৃণমূলে আমাদের বিপাকে পড়তে হয়। মেডিকেল অফিসারের নিয়মিত দায়িত্বের বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে হয়। আবার অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসারের আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন অপারেট করার প্রশিক্ষণ না থাকায় চালু করাও সম্ভব হয় না। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দ্রুত সনোলজিস্টের পদ সৃজন ও লোকবল নিয়োগ প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপজেলা হেলথ কেয়ার বিভাগের লাইন ডাইরেক্টর ডা. মো. রেজওয়ানুর রহমান বলেন, যেখানে আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন আছে কিন্তু অপারেট করার মতো লোক নেই— সেখানে এসব মেশিন সচল করার বিষয়ে মহাপরিচালক স্যারের নির্দেশনা রয়েছে। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন অপারেট করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে চিৎিসকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। যাতে করে সচল মেশিন পরিচালনা করা যায়। আর অচল মেশিন মেরামতেরও আমাদের উদ্যোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জে বিষয়ক এ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগী নিয়ে এসে কেউ যদি দেখে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মেশিন খারাপ, তাহলে তার অনুভূতিটা কেমন হবে? হাসপাতালের যন্ত্রপাতি যদি ফাংশনাল না থাকে তাহলে হাসপাতাল প্রধানের কাজটা কি? বেশির ভাগ রোগীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেন বাইরে বেসরকারিভাবে করে? এ বিষয়গুলো যেন না ঘটে সেই দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা হাসপাতাল তৈরি করেছি মানুষের চিকিৎসা দেয়ার জন্য। মানুষ চিকিৎসা পেলে আমাদের চাকরি থাকবে। জনগণের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে আগামীতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরো ভালো হবে।