- দেশে বৈধ-অবৈধসহ বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান প্রায় ২২ হাজার
- গত বছর অভিযানে বন্ধ হওয়া ১৮৯৫ প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই সক্রিয়
- প্রায় তিন হাজার প্রতিষ্ঠান কখনো নিবন্ধনের জন্য আবেদনই করেনি
হাসপাতালগুলোর মানভেদে সুযোগ-সুবিধার আলোকে সেবামূল্য নির্ধারণ করা হবে -জাহিদ মালেক, মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়
সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া শুধু ক্যাটাগরি করে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় -অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব, সাবেক সভাপতি, বিএমএ ও আহ্বায়ক, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন
সরকার স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের মৌলিক অধিকার নয় পণ্য হিসেবে দেখছে -ফয়জুল হাকিম, আহ্বায়ক, জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদ
ক্যাটাগরি ভাগ করে সেবামূল্য নির্ধারণের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আমরাও একমত -অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া, সভাপতি, প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন
নিয়ন্ত্রণহীন দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। মুনাফার লোভে শহর থেকে প্রান্তিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে দেশে প্রায় ২২ সহস্রাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। বিস্তৃত এ খাত দেখভাল করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতেগোনা কয়েকজন।
এ সুযোগে কখনো নিবন্ধনের আবেদন করেনি এমন তিন সহস্রাধিক হাসপাতাল-ক্লিনিক ব্যবসা পরিচালনা করার সাহস দেখাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবার নামে কী হচ্ছে তার কোনো তথ্য নেই সরকারের হাতে। আবার ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন থাকলেও সেখানেও রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ।
সম্প্রতি রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় ইউসুফ হাসান আল হিন্দি নামে মার্কিন নাগরিক ও গালফ এয়ারের এক পাইলটের মৃত্যুর অভিযোগ করেছে তার পরিবার।
গত সোমবার নিহতের বোন তালা এলহেনদি অভিযোগ করে বলেন, ভুল চিকিৎসায় ও অবহেলায় তার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। এ জন্য তিনি প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধনও বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। যদিও ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এদিকে দেশের অবৈধ ও নিবন্ধিত সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মের মধ্যে আনতে গত বছর দুই দফায় অভিযান চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর গড়িয়েছে অনেক সময়। সেই অভিযানে বন্ধ হওয়া এক হাজার ৮৯৫টি প্রতিষ্ঠানের বড় অংশ নিয়মবহির্ভূতভাবে চলছে।
অভিযোগ রয়েছে, এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা রয়েছে। কেউ কেউ নাম পরিবর্তন করেও ফের কার্যক্রম চালু করেছে। এই যখন দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা। ঠিক তখন তড়িঘড়ি করে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সেবামূল্য নির্ধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে এ সংক্রান্ত একটি পর্যালোচনা বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। যারা আগামী এক মাসের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ক্যাটাগরি নির্ধারণের বিষয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করবেন। সেবার মান অনুযায়ী বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের এ, বি, সি ও ডি ক্যাটাগরি প্রস্তুত করবে। সেই অনুযায়ী সেবামূল্য নির্ধারণ করবে। আশা করা হচ্ছে, এতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পাবে। জনগণের অযাচিত অর্থ ব্যয় কমবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বেসরকারি হাসপাতালের বেড সংখ্যা, যন্ত্রপাতি, অবস্থান, লোকবল, সুযোগ-সুবিধা ভেদে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ. বি.সি ও ডি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে দেয়া হবে। এ ক্যাটাগরির এক রকম সুবিধা, বি ক্যাটাগরির এক রকম সুবিধা এবং সি ক্যাটাগরি হাসপাতালগুলো মান ভেদে এবং সুযোগ-সুবিধা উল্লেখসহ সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করা থাকবে। এতে মানুষ আগে থেকেই জানতে পারবে কোন হাসপাতালে গেলে কি কি সুবিধা পাওয়া যাবে এবং কত চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হবে।
রোগী ও স্বজনদের ভাষ্যমতে, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিককে ক্যাটাগরি নির্ধারণের আগে এ খাতে সরকারের সক্ষমতা ও তদারকি বাড়ানো দরকার। অবৈধ প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করেও সরকার যেখানে বন্ধ রাখতে পারে না সেখানে শুধু ক্যাটাগরি নির্ধারণ করে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ হবে শুভঙ্করের ফাঁকি। কোনো প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন আছে কিংবা নেই সেটি সাধারণ মানুষ জানে না। নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠানও আইনের দোহাই দিয়ে এ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানের আদলে অর্থ আদায় করবে। এতে বাড়তে পারে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব আমার সংবাদকে বলেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা আছে? অবৈধ, অনিবন্ধিত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পর যেখানে রাতারাতি চালু হয়ে যায় সেখানে শুধু ক্যাটাগারি করে শৃঙ্খলায় আনা সম্ভব?
তিনি আরও বলেন, অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ব্যতীত মানহীন প্রতিষ্ঠানও এ ক্যাটাগরি প্রতিষ্ঠানের ফি আদায় করবে। এতে রোগীর ব্যক্তিগত খরচ আরও বাড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ২২ হাজারের মতো। গত ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে ১৮ হাজার ৭৩৩টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত ১৩ হাজার ৬৯৬টি। সব শর্ত পূরণ না করাসহ নানা জটিলতায় নিবন্ধনের অপেক্ষায় পাঁচ হাজার ৩৭টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ আবেদনই দুই হাজারের মতো। প্রায় তিন হাজার প্রতিষ্ঠান আবেদনই করেনি। গত বছর দেশব্যাপী দুই দফা মে ও আগস্টে চালানো অভিযানে এক হাজার ৮৯৫টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল। কিছু প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের আওতায় এলেও বড় অংশ নিয়মবহির্ভূতভাবেই চলছে। ব্যতিক্রম শুধু চট্টগ্রাম। সেখানে বন্ধ করা কোনো প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণ না করে চালু করতে পারেনি।
জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ফয়জুল হাকিম আমার সংবাদকে বলেন, সরকার স্বাস্থ্যকে অধিকার হিসেবে না দেখে পণ্য হিসেবে দেখছে। স্বাস্থ্য নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বাণিজ্যিকীরণের পথে হাঁটছে। কর্পোরেট হাসপাতাল, প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিককে এত বছর পর সরকার শৃঙ্খলায় ফিয়ে আনার যে কথা বলছে তা জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিরসনের ঘোষণা মাত্র। বাস্তবে বাস্তবে কি করে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া আমার সংবাদকে বলেন, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা দেয়া আমাদের অঙ্গীকার। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে সেবার মানের ভিত্তিতে ক্যাটাগরিতে ভাগ করে মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে আমরাও সরকারের সাথে একমত। উদ্যোগ বাস্তবায়নে আমরা সবাই মিলে এক সাথে কাজ করব। ধাপে ধাপে কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাব।