- বছরে বাড়ছে প্রায় আড়াই লাখ নতুন রোগী
- পুরুষের ফুসফুস আর নারীর স্তন ক্যানসার বেশি
- চিকিৎসায় গড়ে খরচ হচ্ছে প্রায় সাত লাখ টাকা
- সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২০ ভাগ রোগীর চিকিৎসা সক্ষমতা
- প্রতি বছর ক্যানসারে প্রাণ হারাচ্ছে লক্ষাধিক মানুষ
শরীয়তপুরের ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা আৰু আলেম। পেশায় কৃষক। দুই ছেলে এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে তার মধ্যবিত্ত সংসার। টানা কয়েক মাস তার হঠাৎ হঠাৎ জ্বর। কোনো ওষুধেই কাজ করছিল না। গত বছর জুলাইয়ে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক তার পরিবারকে জানান, আবু আলেমের ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়েছে। রোগটি এখন তৃতীয় ধাপে রয়েছে। এ মুহূর্তে কেমো রেডিওথেরাপিই ভরসা। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা দরকার। কিন্তু বিএসএমএমইউতে কেমো রেডিওথেরাপির জন্য অপেক্ষা করতে হবে লম্বা সিরিয়ালে। দরিদ্র পরিবারটি বাধ্য হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করে। কেমো ও রেডিওথেরাপি শেষে রোগীর অবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত।
এদিকে রোগ শনাক্তকরণ ও রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে কৃষক পরিবারটি এখন নিঃস্ব। প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি অর্থ। ব্যয়ের কারণে তাদের পালের গরু, হালের জমি বিক্রি করতে হয়েছে। এদিকে গত ১৮ জানুয়ারি ভারতের চেন্নাইয়ে ক্যানসারের চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন।
পিরোজপুরের কৃষ্ণা রানী। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কৃষ্ণা তিন সন্তানের জননী। দু’বছর আগে তার স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর তিনি ভারতের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করেন। ভারতে যাতায়াত, চিকিৎসা ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ মেটাতে গিয়ে পরিবারটির অন্তত ১০ লাখেরও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। অপারেশন শেষে তিনি এখন সুস্থ।
তবে আক্ষেপ করে তিনিও বলেন, ক্যানসার চিকিৎসা ব্যয় সবার পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়। এ খাতে সরকারের আরও বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
তথ্য ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৫ লাখের বেশি ক্যানসার রোগী রয়েছেন।
অনকোলজি ক্লাবের তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ ক্যানসার আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যুও হচ্ছে লক্ষাধিক রোগীর। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তিনটি হাসপাতালে ক্যানসার রেজিস্ট্রির কাজ শুরু করেছে। জাতীয়ভাবে ক্যানসার রেজিস্ট্রি করলে ধারণা পাওয়া যাবে কোন ধরনের ক্যানসারের রোগী কোন স্তরে আসছে। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩৬ হাজার রোগীর ডায়াগনসিস করেছে। এ সময়ে ৮৩ হাজার ৭৯৫ নতুন রোগী এলেও ডায়াগনসিস হয়েছে ৩৫ হাজার ৭৩৩ জনের। এতে ৪২ দশমিক ছয় শতাংশের ক্যানসার শনাক্ত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যানসার ইনস্টিটিউটে আসা রোগীদের ৫৫ শতাংশ নারী এবং ৪৫ শতাংশ পুরুষ। নারী-পুরুষ উভয়ের সবচেয়ে বেশি ফুসফুসের ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে, যার শতকরা হার ১৭ দশমিক চার শতাংশ । আর লিঙ্গভেদে পুরুষ ক্যানসার রোগীর সবচেয়ে বেশি ২৬ দশমিক ছয় শতাংশ ফুসফুসের ক্যানসার পাওয়া যায়। আর নারীদের মধ্যে ২৯ দশমিক তিন শতাংশ রোগী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রয়োজনের তুলনায় দেশে ২০ শতাংশ মেশিন আছে । ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগী রেডিওথেরাপি পান; অন্যরা পান না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আমাদের দেশে ক্যানসার বিশেষজ্ঞের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এ মুহূর্তে অন্তত ৮০টি কেন্দ্র দরকার। যেখানে তিনটি করে রেডিওথেরাপি মেশিন থাকা প্রয়োজন, সেখানে আমাদের আছে মাত্র ৩৭-৩৮টি। এ জন্য গরিব মানুষ রেডিওথেরাপি চিকিৎসা নিতেই পারছে না।
সম্প্রতি ভারতের ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে যেসব ক্যানসারের রোগী তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে যান, তারা অনেকেই তৃতীয় বা চতুর্থ ধাপের রোগী। তাই শুরুতেই দেশে যদি এটা শনাক্ত করা যায়, তাহলে রোগীরা উপকৃত হবেন। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হলে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর আর্থিক ক্ষতি ও মৃত্যুহার কমানো সম্ভব।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপদান হলো প্রাথমিক প্রতিরোধ, সূচনায় ক্যানসার নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রশমন সেবা বা পেলিয়েটিভ চিকিৎসা। কিন্তু দেশে ক্যানসারের জন্য বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় হচ্ছে অবকাঠামো ও অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের পেছনে। ক্যানসার নির্ণয় ও স্ক্রিনিং খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পরিবারে ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়েছে, তাদের প্রায় ১৭ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। যারা ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখেছি, একজন রোগীর পেছনে সাড়ে ছয় থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেগে যায়। আর এই খরচটা মূলত ক্যানসারের ধরনের ওপর অনেকটা নির্ভর করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. শামিউল ইসলাম বলেন, পরিবেশ ও খাদ্যাভ্যাসও ক্যানসারের বড় একটি কারণ। ধূমপানসহ নানা অভ্যাসের কারণে নিজেরাই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হচ্ছি কি না, তা ভেবে দেখা উচিত। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ইনস্টিটিউট দরকার। পাশাপাশি এটি নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, দেশে চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার বড় একটি কারণ ক্যানসার। রাষ্ট্রের এই জায়গায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মেডিকেল সায়েন্সেসে যেখানে প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে, সেখানে এখনো আমরা পিছিয়ে। ডায়াগনসিস করতে পারছি না। এটি কেন হবে?