দলীয় প্রধান ও সাধারণ সম্পাদককে অপপ্রচারে টার্গেট করা হয়েছে -সাদেকা হালিম
উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারাকে ব্যাহত করার জন্য গুজব ও অপপ্রচার করা হয় -সুজিত রায় নন্দী
বিরোধী শক্তিগুলো এসবের পেছনে পেইড কর্মী রাখে -আব্দুল আউয়াল শামীম
ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টারের মাধ্যমে গুজব ও অপপ্রচার রোধে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে -জুনায়েদ আহম্মেদ পলক
অব্যাহত গুজব ও অপপ্রচারে আক্রান্ত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে দিয়েও, বেশ তৃপ্তির হাসি হাসছেন গুজব রটনাকারীরা। অনলাইনে খোদ দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য হরহামেশাই চোখে পড়ছে। পদ্মা সেতুর মানুষের মাথার প্রয়োজন, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানানো হয়েছে, এমন গুজবও ছড়ানো হয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকে টাকা নেই এই গুজবে আক্রান্ত হয় দেশ এবং মুহুতে সারা দেশে এটি ছড়িয়ে পড়ে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদের অপপ্রচার প্রতিরোধে একাধিকবার তাগিদ দিয়েছেন দলীয় প্রধান। অতীতে সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার মতো গুজবকেও দ্রুত ছড়িয়ে দিয়েছিল একটি গ্রুপ। এতে দেশে ধর্মপ্রাণ মানুষদের অনভূতিতে প্রভাব ফেরেছিল বিষয়টি। ইতোপূর্বে বহুবার গুজব ছড়ানো হয়েছে। নৌকায় ভোট দিলে বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে। মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে এবং ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। এমনকি সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও গুজব ছড়াতে পিছপা হননি। জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু করা হয়েছে এবং কেউ এই সেতুতে উঠবেন না।
সাধারণত অনিবন্ধিত অনলাইন পোর্টাল, আইপি টিভি, ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল নিজেদের মতো করে গুজব ছড়ানো হয়, অপপ্রচার করে ও বিভ্রান্তি ছড়ায়। একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে এই কাজটি করে যাচ্ছে। অথচ দলের পক্ষ থেকে কিছু বক্তব্য বিবৃতি ও হাতেগোনা কয়েকটি মামলা ছাড়া তেমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই আওয়ামী লীগের। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সভাপতি বিরোধীদের অপপ্রচারের একাধিকবার তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামেও এ বিষয় নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করেছেন তিনি। তিনি আওয়ামী লীগের সব সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনকে অপপ্রচারের জবাব দিতে বলেছেন বেশ দৃঢ়ভাবে।
তিনি সম্প্রতি ছাত্রলীগের সম্মেলনে বলেছেন, ওরা যখন আমাদের বিরুদ্ধে যেটা লেখে তার জবাবে ওদের অপকর্মটা যদি কমেন্টে ছেড়ে দেয়া যায়, তাহলে ওরা ওটা বন্ধ করে দেবে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো। অপপ্রচারের বিষয়টি বর্তমান রাজনীতির কতটা গুরুত্বপূর্ণ- প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য থেকে তা সহজেই অনুমেয়। কারণ আওয়ামী লীগ ও সরকারবিরোধী অপপ্রচার এখন তুঙ্গে, এতে সন্দেহ নেই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, এটি নতুন কিছু নয়, যারা অপরাজনীতি ও প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, এই গুজবের রাজনীতিতে তারাই অভ্যস্ত। মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে এই দলটি (বিএনপি) দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসছে। বাংলাদেশে দল দুটি— একটি আওয়ামী লীগ ও একটি এন্টি আওয়ামী লীগ। সারা বিশ্ব পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারকে ধন্যবাদ দিলেও, গুজব রটনাকারী বিরোধীরা একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিতে পারেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও একটি দেশবিরোধী চক্র গুজব রটিয়েছে। ৭৩ বছরের ঐতিহ্য বহনকারী দল আওয়ামী লীগ সীমাহীন গুজব ও অপপ্রচার অতিক্রম করে এ পর্যন্ত এসেছে। বাংলাদেশকে অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই মহলটি নানা সময়ে অপপ্রচার করছে।
এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে সবসময় সবাইকে সতর্ক ও সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ সব গুজব ও অপপ্রচার প্রতিরোধ করতে পারে। মূলত উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে ব্যাহত করার জন্য গুজব ও অপপ্রচার করা হয়। এসব মোকাবিলা করেই সরকার ও দলকে পথ চলতে হচ্ছে। আমরা সজাগ ও সতর্ক আছি। এসব গুজবে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত নই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক তথ্য কমিশনার অধ্যাপিকা সাদেকা হালিম বলেন, বিপক্ষ দলের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এটি ব্যবহার করছেন। যত্রতত্র ঢিল মারা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রটানো হচ্ছে। এই অপপ্রচারকে একটা কৌশল হিসেবে নেয়া হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলের সাধারণ সম্পাদককে টার্গেট করা হয়েছে। যারা গ্রামগঞ্জে বাস করে সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ, তাদেরকে যদি আমরা বারবার মিথ্যে কথা বলতে থাকি, গোয়েবলসের মতো, তখন এসব লোকজন মনে করবে- এটাই ঠিক। যারা এসব করছে আমি মনে করি এটা একটা কাপুরুষিত কাজ। এসব থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করা উচিত। আমি মনে করি, জনগণকে সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশের জনগণকে এ ধরনের কথা বলা মানে, জনগণ তো আর হোমজিনিয়াস না। এখানে ধর্ম ও শ্রেণিগত বিভাজন আছে, লেখাপড়ার মানসহ সব কিছুতে একটা বিভাজন আছে। আমি মনে করি, যখন এসব গুজব ছড়ায় তখন ডায়ালগের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে এ সব বিষয় খণ্ডন করা উচিত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত উপপ্রচার সম্পাদক আবদুল আউয়াল শামীম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক বিস্তারে কাজ করেছে। গুজব ও অপপ্রচার রোধ করা যায় না। এটি বাতাসের বেগে চলে। এ দেশের প্রচুর মানুষ এন্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করে। তারা যা দেখে তা সবই বিশ্বাস করে না। যারা গুজব ছড়ায় তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।
তিনি বলেন, তারা এ কাজের জন্য পেইড কর্মী। মূলত বিরোধী শক্তিগুলো এসবের পেছনে কাজ করে। তারা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পানি ঘোলাটে করতে চায়। এটি দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে আমার কাছে মনে হয়। আওয়ামী লীগ অপ্রপচার ও গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা তাদের ওপর চপেটাঘাত মারার মতো।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহম্মেদ পলক আমার সংবাদকে বলেন, আইনের কঠোর প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেকোনো অভিযোগ পেলেই তা যাচাই করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টারের মাধ্যমে গুজব ও অপ্রপ্রচার রোধে নানারকম জনসচেনতামূলক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। জনগণকে এর শিখন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। সারা দেশের জেলাপ্রশাসকদের গুজব প্রতিরোধে জনসচেতনতার কাজে ভূমিকা রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নানা রকম গুজব ও অপ্রচার রোধে আওয়ামী লীগ কি পদক্ষেপ নিচ্ছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুব মহিলা লীগের সাবেক সহ-সভাপতি কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি বলেন, দেশ এগিয়ে গেলে বিপক্ষের কিছু মানুষ ষড়যন্ত্র করে, অসত্য তথ্য ছড়ায়। আমরা গুজব ও বিভ্রান্তিকর এসব তথ্য প্রতিরোধের চেষ্টা করছি।
আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপকমিটির সদস্য কারুজ্জামান খান সুইট বলেন, আমাদের উপকমিটি জেলা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গুজবের বিরুদ্ধে ফ্রি অনলাইন ও অফলাইন ট্রেনিং দিয়েছে। তা ছাড়া এই উপকমিটি, গুজব সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণ করে জবাব দেয়ার জন্য একটি শক্তিশালী সাইবার মনিটরিং টিম তৈরি করেছে।
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য জসিমউদ্দিন আকন্দ রনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অনলাইনে আক্রান্ত হন। কিন্তু আমাদের দলের মধ্যে কোনো সমন্বিত ভূমিকা নেই।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ধর্ম-উপকমিটির সদস্য জামালউদ্দিন মাহী বলেন, গুজব ও অপ্রচার প্রতিরোধে আমাদের দলের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই তেমন সক্রিয় নন। তাদের অনেকে এ বিষয় ততটা বোঝেন না। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাসান মাহমুদ সম্প্রতি জেলা প্রসাশকদের গুজব ও অপপ্রচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনা দেন। গুজবের ঘটনা ঘটলে মন্ত্রণালয়ের গুজব সেলকে অবহিত করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন হলো- সেটি কতদিনে জানাবেন ডিসিরা? মুহূর্তে ছড়ানো গুজব ততদিনে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশ ও বিশ্বজুড়ে। কারণ গুজব ছড়ায় কয়েক ঘণ্টায় কিন্তু এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সময় লাগে কয়েক দিন।
এভাবে গুজব প্রতিরোধ কতটুকু সম্ভব?
গুজব ও অপপ্রচারের বিষয়ে জানতে চাইলে একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, গুজবের মতো কোনো বিষয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেলে তা সঙ্গে সঙ্গে ব্লক করা এবং অপরাধীকে দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব ও ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, একটি পোস্ট দেশের মধ্যে শনাক্ত করতে গেলে কয়েকটি মাধ্যম জরুরি। মোবাইল টেলিকম অপারেটর, ফেসবুক লিংক অথবা লোকেশন, জিও লোকেশন ধরে ট্রেস করা হয়। দেশের বাইরে গেলে সময় একটু বেশি লাগে। কোথা থেকে পোস্টটি করা হচ্ছে তা দুই-তিন দিনের মধ্যে শনাক্ত করা সম্ভব। শনাক্ত করতে দেরি হলেও "ইউআরএল'টা দ্রুত ফিল্টার করা সম্ভব। সরকার ছয় কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীকে মনিটর করার জন্য কতজনের মনিটরিং সেল গঠন করেছে সেটি দেখা দরকার। গুজবের পেছনে অনেক সময় নিয়ে এবং বড় কোনো পরিকল্পপনা কাজ করে। সুনিয়ন্ত্রিত গ্রুপের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়। গুজব ও অপ্রপচারের কারণে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের আগে একটি অনলাইন গ্রুপ নানরকম বানোয়াট তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে, দ্রুত তা ছড়িয়ে দেয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ অস্বস্তিতে পড়ে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের এসব প্রকল্প ও ব্যয় নিয়ে অবিশ্বাস তৈরি হয়।
নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে একজন প্রকৌশলী আমার সংবাদকে বলেন, আমরা এসব অপপ্রচার ও গুজবের ফলে অস্বস্তিতে পড়ে যাই। সাধারণ লোক গড়পড়তা আমাদের অনৈতিক ভাবতে শুরু করে। পেশাগত জায়গায় সততা বজায় রেখেও এসব অপপ্রচারের কারণে সামাজিকভাবে বিতর্কে পড়তে হয়। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর প্রকল্প ব্যয় নিয়ে এক ধরনের ভ্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বেশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী নেপথ্যে সরব হয়।
এ বিষয়ে বিশেষ করে বিএনপির দিকে আঙ্গুল তোলেন অনেকে। বেশ কয়েক বছর আগে রাজধানীর বাড্ডায় একজন স্কুলশিক্ষার্থীর মাকে ছেলেধরা বলে গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। সত্য জানার পর ঘটনাটি সার দেশের মানুষের ভেতর আলোড়ন তোলে।
তথ্যের বিকৃতি ও অতিরঞ্জনের কারণে গুজব জনজীবনকে নানাভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। গুজব খুব সহজেই মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, তাই অনেকে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যকে কেন্দ্র করে সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু গুজব ও সত্যটা জানার মধ্যবর্তী সময়টুকু সহিংসতা ঘটে যায়, এমনকি বহু মানুষের সম্মানহানি হয়। এটি আর উদ্ধার হয় না এবং সরকার যদি সঠিকভাবে ও দ্রুত গুজব ও অপপ্রচারকে সামাল দিতে না পারে তাহলে দল সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতির সম্ভাবনা রয়ে যাবে।