উৎপাদনে সর্বোচ্চ খরচ

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩, ০২:৪৭ পিএম
উৎপাদনে সর্বোচ্চ খরচ
  • মাসে গচ্চা যাবে ৭০০ কোটি টাকা
  • চুক্তির সংস্কার চায় পিডিবি আদানির ‘না’
  • রামপাল-পায়রায় কয়লার দাম প্রতি টন ২৫০ ডলার
  • আদানি দাম ধরতে চায় ৪০০ ডলার

আমদানি করা তরল জ্বালানি দিয়ে চলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট ও দেশে ডলার সংকটে ঋণপত্র (এলসি) বন্ধ করে দেয় সরকার। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ডিজেলের পরিবর্তে কয়লার দিকে ঝুঁকছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কয়লাভিত্তিক চলমান দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি কয়েক মাসে যুক্ত হবে আরও তিন কেন্দ্র। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, কয়লাভিত্তিক পাঁচ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয় আদানির বিদ্যুতের।

তথ্যমতে, ২০০৬ সালে দেশে প্রথম বড়পুকুরিয়ায় কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে ওঠে। আলোচিত-সমালোচিত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে এসে ২১টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘোষণা করা হয়। নানা সমস্যায় পরে ১৩টি কেন্দ্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। বাকিগুলোর মধ্যে দুটি এরই মধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে এবং শিগগিরই আরও তিনটি উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বাংলাদেশের সঙ্গে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎবিষয়ক ১৬৩ পৃষ্ঠার ‘গোপন চুক্তি’ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। ভারতীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানির মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কোম্পানি আদানি পাওয়ার থেকে ক্রয়কৃত বিদ্যুতের ওপর ছাড় চাইছে বাংলাদেশ। স্টক এক্সচেঞ্জ ফাইলিংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ডের কাছে পাঠানো একটি চিঠিতে আদানি পাওয়ার জানায়, বাংলাদেশ তাদের কাছে ‘বিদ্যুৎচুক্তিতে একটি ছাড় বিবেচনা’ করার অনুরোধ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘গোপনীয় ১৬৩ পৃষ্ঠার বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তির শর্তাবলির অধীনে, বাংলাদেশ একটি দরিদ্র এবং ভারী ঋণগ্রস্ত দেশ। দেশটি একটি নতুন কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনবে; যা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সচরাচর প্রদত্ত মূল্যকে ছাড়িয়ে গেছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দীর্ঘদিনের মিত্র আদানি নির্মিত।

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, অস্বাভাবিক শর্তাবলির মধ্যে কয়লার মূল্যসীমার বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা নেই। এর অর্থ হলো, আদানি চাইলেই বাংলাদেশের কাছে আরও বেশি অর্থ দাবি করতে পারবে। এর আগে ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের পর জ্বালানি ক্রয় নিয়ে আদানি গ্রুপ ও ঢাকার মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নরেন্দ্র মোদির ওই সফরের পর ভারতের বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গৌতম আদানির সঙ্গে এক দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারে গোড্ডায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করে।

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির কেন্দ্রে কয়লার দাম ধরা হয়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি। ফলে প্রতি মাসে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে প্রায় ছয় কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ৭০০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে আদানির প্রতিনিধির সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ করে পাঁচ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয়ের হিসাব দেখানো হয়। এক্ষেত্রে প্রতি কেন্দ্রের সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার ধরে ব্যয় হিসাব করা হয়েছে।

পিডিবির তথ্যমতে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানিকৃত কয়লার দাম ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টন ২৪৫ ডলার। এক্ষেত্রে প্রতি কেজি কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু (তাপন ক্ষমতা) ধরা হয়েছে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরি। একই মানের কয়লা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কেনা হচ্ছে প্রতি মেট্রিক টন ২৫৪ দশমিক ৩৮ ডলারে। এছাড়া বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এ কয়লার দাম ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টন ২৬০ ডলার, বাঁশখালী এসএস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২৭০ ডলার ও আদানির জন্য ৩৪৭ ডলার। 

এ হিসাবে পায়রার বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির কেন্দ্রে কয়লার দাম বেশি ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টনে ১০২ ডলার বা ৪১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টনে ৭৭ ডলার বা ২৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, আদানি গ্রুপ প্রতি টন কয়লার দাম ধরতে চায় ৪০০ ডলার। এই দরে কয়লা আমদানির ঋণপত্র খোলার কথা তারা জানিয়েছে পিডিবিকে। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রামপাল এবং বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে করা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার দাম পড়ছে প্রতি টন ২৫০ ডলারের মতো।

এদিকে আদানির বিদ্যুতের দাম নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেছেন, আদানি গ্রুপ থেকে উচ্চমূল্য দিয়ে আমরা কেন বিদ্যুৎ আনব! আনলে এটা জনগণের স্বার্থে কি না— এ বিষয়ে সরকার পুনঃপরীক্ষা করে দেখবে।  তাদের থেকে আনা প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য হবে ২৪ টাকা ১০ পয়সা। বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ছয় হাজার কোটি টাকা। আদানি গ্রুপ থেকে এত উচ্চমূল্য দিয়ে আমরা কেন বিদ্যুৎ আনব?

এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে আদানির বিদ্যুৎচুক্তি নিয়ে গৌতম আদানি ইস্যুতে ভারতের লোকসভা সরগরম করে তুলেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে গত মঙ্গলবার তুমুল উত্তেজনা দেখা দেয় লোকসভায়। বক্তব্য দেয়ার সময় বারবার তার কথার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলেন ক্ষমতাসীন বিজেপি দলীয় মন্ত্রী, সদস্যরা। এ নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি তিনি নরেন্দ্র মোদির বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও সমালোচনা করেন। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানির উচ্চমূল্যের বিদ্যুতের প্রভাব পড়বে দেশের বাজারে। এতে  ফের বাড়তে পারে বিদ্যুতের দাম। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বর্তমানে সারা বিশ্বে অস্থিরতার কারণে কয়লাসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে। আদানির বিদ্যুতের দাম যদি অন্যান্য বিদ্যুতের তুলনায় কম হতো, তাহলে সেটা আমাদের জন্য খুবই উপকার হবে। তবে আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত এর একটা সুরাহা হবে।

এবি