- প্রতি লাখে সন্তান জন্মদানজনিত মাতৃমৃত্যু হচ্ছে ১৬৩ জনের
- প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনা
- শিশুমৃত্যু রোধে এমডিজি অর্জন হাতছানি এসডিজি অর্জনের
বিগত বছরগুলোতে সন্তান জন্মদানজনিত মাতৃমৃত্যু তুলনামূলক কমেছে। প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান জন্মদান এ ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কল্যাণে হাতের নাগালে বিনামূল্যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ মিলছে। ইতোমধ্যে শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। তবে সন্তান জন্মদানজনিত মাতৃমৃত্যু হারের এখনো লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি। সরকারি তথ্য মতে, ২০০৯ সালে প্রতি লাখে সন্তান জন্মদানজনিত মাতৃমৃত্যু হার ছিল ২৫৯ জন। সেই সংখ্যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১৬৩ জনে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সন্তান জন্মদানজনিত মাতৃমৃত্যু হার ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিদানস্বরূপ এমডিজি (সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) পুরস্কার অর্জন করেছে বাংলাদেশ। মাতৃমৃত্যু হার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলে এমডিজি অ্যাওয়ার্ডের মতো এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অ্যাওয়ার্ড অর্জনের গৌরবময় হাতছানি। সরকারের এই লক্ষ্য অর্জনে নিরলস কাজ করছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীরা।
মাতৃমৃত্যু হার রোধে সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ইতোমধ্যে তিনটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করছে। প্রথমত, অল্প বয়সে বিয়ে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, অল্প বয়সে প্রেগন্যান্সি বন্ধ করতে হবে এবং তৃতীয়ত, ঘনঘন সন্তান নেয়া বন্ধ করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মূল উদ্দেশ্য শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমানো। দেশে এখনো সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি এক লাখ মায়ের মধ্যে ১৬৩ জন মারা যান। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, বাংলাদেশের মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, বিনামূল্যে হাসপাতাল সেবাকার্যক্রমসহ স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সরকারের নানা উদ্যোগ রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৬৪ ভাগ নারী (১৫-৪৯ বছর বয়সি) গর্ভনিরোধ পদ্ধতি সেবা সরকারিভাবে বিনামূল্যে পাচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে, অধিদপ্তর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ছাড়াও মা ও শিশুস্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিসেবা নিয়ে কাজ করে। পরিকল্পিত পরিবার গঠন পরিবার পরিকল্পনার মূল বিষয়। কারণ, পরিকল্পিত পরিবার হলো আলোকিত পরিবার। পরিকল্পিত পরিবার গঠন করতে পারলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ হবে এবং মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমবে। নিরাপদ প্রসব নিশ্চিতকরণে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরাধীন তিন হাজার ৬৪টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের মধ্যে দুই হাজার ৮৬০টি কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ প্রসবসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ৯৬টি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের মধ্যে ৭০টিতে জরুরি প্রসূতিসেবা দেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বড় সফলতা হলো— প্রতিষ্ঠানটির নানা কর্মতৎপরতায় বর্তমানে দেশে মোট প্রজনন হার প্রায় ২ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (বিডিএইচএস) তথ্য মতে, বর্তমানে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে দুই সন্তানবিশিষ্ট ৭৯ শতাংশ নারী পরবর্তী সন্তান গ্রহণে অনিচ্ছুক, যা ২০০৪ সালে ছিল ৬৭ শতাংশ।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে দেশের প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) ছিল ৬ দশমিক ৯, অর্থাৎ ওই সময়ে একজন মা গড়ে প্রায় সাত সন্তানের জন্ম দিতেন। ১৯৭৫ সালে প্রজনন হার ছিল ৬ দশমিক ৩, ১৯৮১ সালে এটি কমে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ২-এ। এরপর তা আরও কমতে থাকে। সর্বশেষ (২০২০ সাল) বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, দেশের প্রজনন হার এখন ২ দশমিক ৩,
যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে ২ শতাংশে নিয়ে আসার পরিকল্পনা সরকারের। পঞ্চাশ দশকের গোড়াতে স্বেচ্ছামূলক উদ্যোগে বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ইতিহাস সূচনা হয়। কর্মসূচির গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৬৫ সালে পরিবার পরিকল্পনাকে জাতীয়করণ করা হয় এবং সরকারিভাবে পরিবার পরিকল্পনা সেবাদান কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৩-৭৮ সালের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বেগবান করার জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সরকারিভাবে এ দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল প্রথম পদক্ষেপ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালে প্রথম জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করা হয়। পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব অনুধাবন করে ২৫টি মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করে ২০১২ সালে পরবর্তী জনসংখ্যা নীতি প্রণীত হয়। বর্তমানে এ নীতির আলোকে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবার কল্যাণ বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান।