- সরকার ও বিশেষ ব্যক্তিদের সাথে সিরিজ বৈঠকে প্রভাবশালী দেশগুলো
- দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে শীর্ষ দেশগুলোর বার্তা আসছে মনে করা হচ্ছে
- দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে পর্দার আড়ালে কূটনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে
- কূটনীতিতে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে বলে দাবি করছে সরকার
- ইইউ বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় —বলছে আওয়ামী লীগ
- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নিম্নগামী হবে —দাবি বিএনপির
ঢাকায় এসেছেন প্রভাবশালী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিকরা। বৈঠক করেছেন সরকারপ্রধান ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের সাথে। এ নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে চলছে নির্বাচনি হাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরো অনেকের চোখ এখন বাংলাদেশের দিকে। গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তাদের বৈঠক করেছে সরকার। এ ছাড়া বুধবার রাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সিনিয়র উপদেষ্টা ডেরেক শোলে বাংলাদেশের কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের সাথে বৈঠক করে দেশের মানবাধিকার, রাজনীতি ও অর্থনীতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, গণমাধ্যম ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। সচেতন মহলের অনেকের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে শীর্ষ দেশগুলোর পক্ষ থেকে কী বার্তা আসছে তা নিয়ে। নির্বাচন ইস্যুতে কোন পথে এগোচ্ছে দেশ? নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হবে নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে হবে? বিশেষ করে ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফরের আগের রাতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গ্যাংয়ের ঢাকা সফর নিয়ে যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল; এবারের কৌতূহল তার চেয়েও বেশি। যেহেতু সমপ্রতি ক্ষমতাসীন দল থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে— চলতি বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে এটিকে বড় তৎপরতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে চায়। এ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখতে চায় বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অপর দিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুুরী বলছেন, তারা (মার্কিন প্রতিনিধিদল) পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে, দেশে গণতন্ত্র নিম্নগামী থাকবে, নিচের দিকে চলে যাবে, তাদের (সরকার) সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও নিম্নগামী হবে, সহযোগিতা কমে আসবে।
জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সফর করেন। তার সফরের আগের রাতে আকস্মিকভাবে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গ্যাং এক ঘণ্টা ঢাকা সফর করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নীতি উপদেষ্টা ডেরেক এইচ শোলে ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফরের তারিখ নির্ধারিত ছিল। তার ঢাকা সফরের দিনই হঠাৎ করেই দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন খাতরা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাববিস্তারকারী প্রভাবশালী দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একই সাথে ঢাকা সফর নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। এমন কী রহস্য অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে একই দিনে ঢাকা সফর করতে হচ্ছে? কী বার্তা দিচ্ছেন তারা?
অনেকে মনে করছেন, ক্ষমতাসীন সরকার এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কিভাবে করবে এটি তারা এবার আগেই জানতে চাচ্ছেন। এটি এখন স্পষ্ট, এবার জাতীয় নির্বাচনে বড় কূটনৈতিক প্রভাব থাকবে। এতে দেশের লাভ-ক্ষতি এখন থেকেই হিসাব করছে একটি মহল। অনেকে এ-ও মনে করছেন, দেশের নিজস্ব বিষয়গুলোর নিয়ে পর্দার আড়ালে কুটনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নীতি উপদেষ্টা ডেরেক এইচ শোলে ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন খাতরা গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে পৃথক পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন। ডেরেক শোলে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কী বিষয়ে আলোচনা করেছেন তা জানা যায়নি। তবে ডেরেক শোলের সাথে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টই বলেছেন, নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে আমার দল (আওয়ামী লীগ) দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। কখনো ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না। আমি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন খাতরার আলোচনা বিষয় প্রকাশ করা হয়েছে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বের প্রতি আমাদের (ভারত) পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ সব ধরনের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে চায়। এ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সিলেট নগরের টিলাগড় এলাকার সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি মন্তব্য করেন। এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, গত সাত মাসে আমেরিকার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি একের পর দেশে এসে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। তাদের দেশে গিয়ে নেতাদের সাথে আলাপ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তার জন্য। ভুল বোঝাবুঝি সব দূর করে ভালো সম্পর্ক তৈরি করা উভয় দেশের চাওয়া। সমপ্রতি অনেক দেশের কূটনীতিক দেশে এসেছেন জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, কূটনীতিকরা বাংলাদেশকে তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশ মনে করেন। কারণ, বাংলাদেশে বিভিন্ন সুযোগ রয়েছে। কোভিডের সময় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আয়ের দিক থেকে প্রথম ছিল। দেশে নতুন নতুন যে সম্ভাবনা আছে, সে সবের সাথে তারা সম্পৃক্ত হতে চান।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখতে চায়। তিনি বলেন, ‘ইইউর সাতটি দেশের সাথে কথা বলেছি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে আজকে বৈঠক করা। তারা চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশগ্রহণ করবে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে ইইউভুক্ত সাত দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান। আগামী নির্বাচন নিয়ে ইইউর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দলের মত কী— এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলেছি যেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার তার বক্তব্যে বলেছেন, আগামী নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু, অবাধ হবে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং নির্বাচন কমিশনকে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে আজকে আমাদের বক্তব্যের কোনো ভিন্নতা নেই। প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন আমরা তাই প্রতিধ্বনি করেছি। একই সাথে আমরা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সার্বিকভাবে বলতে গেলে বিশ্বে একটি সংকট চলছে। এই সময়ে সব দেশই চাইছে ব্যবসা-বাণিজ্যের ও সহযোগিতার উন্নয়ন ঘটাতে। সেটি ওইসব দেশের জন্য যেমন প্রয়োজন, আমাদের দেশের জন্যও প্রয়োজন। ফলে এই সফরগুলো কাকতালীয়ভাবে একই সাথে হলেও আমার মনে হয় সবার আলাদা আলাদা অ্যাজেন্ডা আছে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা— এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু আছে। সাম্প্রতিক মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতা এমন একজন লোক যিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কানে সরাসরি কথা তুলতে পারেন। ফলে তিনি সফর শেষে তাকে বাংলাদেশের সার্বিক বিষয়েও জানাবেন।’ আর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এসেছেন জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দাওয়াত দিতে। কিন্তু পাশাপাশি সম্পর্কটা আরো ঝালাই করে নিতে চাইবেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব, মনে করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।