সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার বা ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস এখন অপেক্ষা মাত্র। মার্চ থেকে এই কার্যক্রম সীমিত পরিসরে শুরু হতে যাচ্ছে। আগামী আগস্টে সারা দেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এ জন্য গত ২২ জানুয়ারি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমানকে প্রধান করে একটি ইনস্টিটিউশনাল চেম্বার নামে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা একটি খসড়া নীতিমালাও প্রণয়ন করেছেন। আগামী পহেলা মার্চে সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার চালুর কথা ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুইজারল্যান্ডে পঞ্চম আন্তর্জাতিক মিনিস্ট্রিয়াল সম্মেলন শেষে গতকাল দেশে ফিরেছেন। তাই বিলম্বিত হতে পারে। কারণ তিনি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবেন ঠিক কবে নাগাদ প্রাইভেট চেম্বার চালু হবে।
এদিকে প্রাইভেট চেম্বার চালু করা নিয়ে নিম্ন আয়ের রোগী ও সাধারণ চিকিৎসকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একনাগাড়ে চেম্বার করা চিকিৎসকদের জন্য অসম্ভব। কারণ এতে চিকিৎসকদের বিশ্রাম বিঘ্ন ঘটবে। সরকারি হাসপাতালের বাইরে প্রাইভেট চেম্বার চিকিৎসকদের জন্য লাভজনও বটে। যদিও এ বিষয়ে অনেক চিকিৎসকের দ্বিতম রয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পরিবর্তন হবে সেটি বিশ্বাস হচ্ছে না। কারণ একই চিকিৎসক সকালে বিনেপয়সায় আর বিকেলে টাকার বিনিময় দেখলে রোগীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। আবার সকালে চিকিৎসকও ঠিক সময়ে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কমে আসতে পারে। এর চেয়ে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে রোগ নির্ণয়ের পরিসর বৃদ্ধি ও বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের হার বাড়ালে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার মাইলফলক দ্রুত অর্জিত হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ইনস্টিটিউিশনাল প্র্যাকটিসের কারণে রোগীর ভিড় কমবে। কম টাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাবেন নিম্ন আয়ের মানুষ। রোগী ও চিকিৎসক উভয়েই লাভবান হবে।
ইনস্টিটিউশনাল চেম্বারের খসড়া নীতিমালা থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন সরকারি হাসপাতালে বহির্বিভাগে রোগী দেখা হয় সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। প্রাইভেট চেম্বারের সময় বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। সপ্তাহে ছয়দিন অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও কনসালট্যান্টদের সরকারি সেবার বাইরে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের ফি ৩০০ টাকা। কনিষ্ঠ চিকিৎসকের ফি ১৫০ টাকা। ৩০০ টাকা ফি থেকে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক পাবেন ২০০ টাকা। তার সহায়তাকারী পাবে ৫০ টাকা এবং বাকি ৫০ টাকা সরকারি তহবিলে জমা হবে। ১৫০ টাকা ফি থেকে কনিষ্ঠ চিকিৎসক পাবেন ১০০ টাকা, চিকিৎসকের সহায়তাকারী পাবেন ২৫ টাকা। বাকি ২৫ টাকা জমা হবে সরকারি তহবিলে।
প্রথম পর্যায়ে উপজেলা পর্যায়ে ৫০টি, জেলা পর্যায়ে ২০টি, বিভাগীয় পর্যায়ে আটটি ও বিশেষায়িত পাঁচটি সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার চালু হবে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ঠিক করা হয়েছে রোগীর উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে। যেসব হাসপাতালে রোগী বেশি আসে, সেখানে এ সেবা চালু করা হবে। আগামী আগস্টের মধ্যে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার চালুর পরিকল্পনা করছে মন্ত্রণালয়। প্রাইভেট চেম্বারে কনসালটেশন, ডায়াগনস্টিক, ল্যাবরেটরি, রেডিওলজি, ইমেজিং ও সার্জিক্যাল সেবা দেয়া হবে। চিকিৎসকরা পালা করে রোগী দেখবেন। একজন অধ্যাপক সপ্তাহে দুদিন, সহযোগী অধ্যাপক দুদিন, সহকারী অধ্যাপক দুদিন রোগী দেখবেন। চিকিৎসক যদি রোগীকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন, রোগী চাইলে তা সরকারি হাসপাতালে করতে পারবেন। আবার বেসরকারি হাসপাতালেও করতে পারবেন।
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. কবির আলম বলেন, ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস বা প্রাইভেট চেম্বার বাধ্যতামূলক করা হলে আমাদের চিকিৎসকদের বাড়তি চাপ তৈরি হবে। দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে বিএসএমএমইউর সাথে তুলনা করলে হবে না। সেখানে চিকিৎসকের সঙ্কট নেই। মফস্বলে আমরা যারা চিকিৎসক রয়েছি। আমরা সকাল থেকে ২টা পর্যন্ত সরকারি সেবা দিয়ে থাকি। এরপর বিরতিহীনভাবে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চেম্বার করলে আমাদেও বিশ্রাম কোথায়? অনেকে সরকারি ডিউটির বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে না। বিশ্রাম নেয়। তার সেখানেও বিঘ্ন ঘটবে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক বিষয় চিন্তা করলে দেখা যাচ্ছে আমরা এখন প্রাইভেট চেম্বারে ৩০০-৪০০ টাকা নিয়ে থাকি। ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসে আমাদের দেয়া হবে মাত্র ১০০ টাকা। এই নীতিমালা চালু হলে সিনিয়ররা সব সময় দুই শিফটের চেম্বার জুনিয়রদের ওপর চাপিয়ে দেবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসে কোনো তাৎপূর্যপূর্ণ পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না। সকালে যেখানে বিনেপয়সায় চিকিৎসা, ওষুধ প্রাপ্তির সুযোগ রযেছে। সেখানে মানুষ বিকেলে কেন পয়সা খরচ করে চিকিৎসা নেবে? এই নীতিমালা বা চেম্বার ব্যবস্থার প্রচলনের চেয়ে রোগ নির্ণয়ের সুযোগ বৃদ্ধি, ওষুধ সরবরাহ বৃদ্ধি ও খাবারের মান নিয়ে কাজ করা দরকার। নয়তো সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।’ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমান বলেন, এখনো ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস বিষয়ের নীতিমালা চূড়ান্ত হয়নি। শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে। কবে নাগাদ চেম্বার শুরু হবে সে বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন। পহেলা মার্চ শুরু হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপাতত এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।’ ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী নাসরুল্লাহ শাকুরি গতকাল চিকিৎসা নিতে আসেন বিএসএমএমইউতে। সেখানে তিনি বলেন, মফস্বলে সকালে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে। সেখানে বিকেলের শিফটে স্বাস্থ্যসেবাকে বাণিজ্যিকিকরণ করা মোটেই কাম্য নয়। এতে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি হবে।