- সিরিজ বিস্ফোরণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা অগ্নিকাণ্ডের সপ্তাহ
- চারপাশে যেন মৃত্যুর আয়োজন উদ্বিগ্ন দেশের মানুষ
সুশীলরা বলছে, তদন্তের কথা। ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিত বিরোধীদের দিকে। বিরোধীদের ভাষ্য, কোনো ঘটনা আড়াল করতেই নতুন পরিস্থিতি তৈরির জন্য এসব সৃষ্ট। সচেতন মহলের প্রশ্ন, এসব ঘটনার জবাবদিহি কোথায়?
চারদিকে রহস্য! ঘটছে সিরিজ বিস্ফোরণ। চলছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা। পুড়ছে ঘর। এসব ঘটনায় মানুষ পুড়ে হচ্ছে লাশ! ঘরগুলো জ্বলে হচ্ছে কয়লা! বাতাসে স্বপ্নপোড়া গন্ধ। সন্তানের খোঁজে, বাবার খোঁজে, স্ত্রীর খোঁজে, ভাইয়ের খোঁজে স্বজনরা ছুটছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। অঝোর ধারায় ঝরছে চোখের পানি। অস্থির পুরো দেশের মানুষ! তাকিয়ে টিভি স্ক্রিনে। রাষ্ট্র থেকে মানুষ— সবাই উদ্বিগ্ন। মানুষ বলছে, চারপাশে যেন মৃত্যুর আয়োজন। আকস্মিক কে কখন গর্তে পড়ে বলা যাচ্ছে না। অস্বাভাবিক ঘটনায় নতুন সকালে স্বজন হারানোর সংখ্যা দীর্ঘ হচ্ছে। কেউ বা ঘটনায় বেঁচে গেলেও অঙ্গ হারিয়ে পুঙ্গ হয়ে অনেকটা মৃত্যুবাড়িতেই বসবাস।
একে একে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা হারিয়ে যাচ্ছে। আর এসব ঘটনার পেছনে রহস্যের রাজঘ্রাণ। সুশীলরা বলছেন, তদন্তের কথা। ক্ষমতাসীন দল ইঙ্গিত করছে বিরোধীদের দিকে। আর বিরোধীদের ভাষ্য— কোনো ঘটনা আড়াল করতেই নতুন পরিস্থতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। সচেতন মহলের প্রশ্ন— এসব ঘটনার জবাবদিহি কোথায়? কিংবা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এর উত্তর মিলছে না কেন? দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সংঘর্ষ কিংবা আগুন লাগার পর কয়েক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, কিছু মানুষ পায় আর্থিক সহযোগিতা। মামলা হলেও ধীরে ধীরে সময়ের বাঁকে সব হয়ে যায় ডিসমিস!
গত সাতদিনে বড় পাঁচটি ঘটনায় হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি পুড়েছে। কেউ মরে লাশ হয়েছেন। আবার কেউবা এখনো হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে সহাবস্থান করছেন। গত সপ্তাহের সোমবার সন্ধ্যায় সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৪ জন। গত বছর একই এলাকায় বিস্ফোরণে ৫০ জন মারা যান তার দায় কেউ নেয়নি এবং সমাধান এখনো আসেনি। এর মধ্যে গত ৫ মার্চ সকালে ঢাকার সাইন্সল্যাব এলাকায় তিনতলা বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণ তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এর রেশ না কাটতেই ৭ মার্চ মঙ্গলবার রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে সাততলা ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় ২০ জনের মৃত্যু হয়।
আহত হন দুই শতাধিক। এখনো হাসপাতালে সংকটাপন্ন প্রায় অর্ধশত। এর মধ্যে রয়েছে আরো রহস্যের দুই ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত ৫ মার্চ আগুনে অন্তত দুই হাজার ঘর পুড়ে গেছে। আগুনের ঘটনায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) দায়ী করছেন বাসিন্দারা। আগুন নেভাতে গেলে স্থানীয়দের ওপর গুলি চালানো হয় বলেও দাবি এলাকাবাসীর। এমন ঘটনায় চিন্তিত রাষ্ট্রসহ দেশের বেশির ভাগ মানুষ। এর মধ্যে আবার মতাদর্শগত সঙ্ঘাত। গত ৪ মার্চ পঞ্চগড়ে কাদিয়ানি সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন ও সংঘর্ষের ঘটনায় এখনো উত্তপ্ত পরিস্থিতি। চলছে নতুন নতুন মামলা। গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত ১৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেশের ডানপন্থি, বামপন্থি ও ইসলামপন্থি সব দলেমতে এ নিয়ে চলছে বাগবিতণ্ডা। চলছে একে অপরের প্রতি দায় চাপানোর চেষ্টা।
চলমান এসব ঘটনার মধ্যে অনেক উড়ো খবর আসছে। কেউ বলছে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মানুষের চিন্তাভাবনাকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল এগুলো করে যাচ্ছে। আবার কেউবা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট ও আদানি চুক্তির বিষয়ে তদন্তসহ কিছু বিষয় ভিন্নখাতে প্রবাহিত করারও কোনো পরিকল্পনা হতে পারে। আবার বিরোধীরা বলছে, ভোটের আগে তাদেরকে মামলা দিয়ে অভিযান চালাতেও ভিন্ন কৌশল হতে পারে। তবে দেশের সচেতন নাগরিকরা বলছেন, সব ঘটনার জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ তদন্ত। দোষীদের শাস্তি। সর্বশেষ গুলিস্তানে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়ে র্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান মেজর মশিউর রহমান বলছেন, রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ স্বাভাবিক নয়, এ ঘটনা এসি থেকে ঘটেনি, এটি নিশ্চিত।
আর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, দেশের পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। বাংলাদেশে বর্তমানে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রতিদিন মানুষ নিহত হওয়া অর্থাৎ অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ এখন একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এগুলোকে দুর্ঘটনা বলে সরকারের দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খোন্দকার মোশারফ হোসেন বলেছেন, সরকারের অবহেলা ও ব্যর্থতার কারণে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তাদের ব্যর্থতার কারণে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়। তাদের উসকানিতে তাদের গুণ্ডাপাণ্ডা দিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি অস্বাভাবিক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
দেশের আর স্বাভাবিক অবস্থা নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এসব নাশকতা করছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দেশে একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা কি-না প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই সময়ে এ ধরনের ঘটনা রহস্যজনক। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো প্রকৃত দুর্ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক কিছু! তার সঠিক তদন্ত প্রয়োজন।
কী কারণে এমন বিস্ফোরণ, কেন এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে, তার সঠিক তদন্ত প্রয়োজন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, ঢাকার সায়েন্স ল্যাব, এখন সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনাগুলো কোনো কিছুর ইঙ্গিত কি-না, সেটিও গোয়েন্দাদের দেখতে হবে।