পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ। যেখানে রমজান এলেই দ্রব্যমূল্য লাগাম হারায়। অথচ অন্য দেশের চিত্র উল্টো। পবিত্র এ মাসে দ্রব্যমূল্যে বিশেষ ছাড় নিয়ে হাজির হন ব্যবসায়ীরা। যদিও অনেক আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে; সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পারলেই রমজানে পণ্যের কোনো সংকট হবে না। এবারে রোজায় কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না বলে আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বাজার তদারকির মাধ্যমে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে তৎপরতা বৃদ্ধির কথা বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কিন্তু কারো কথায় চিড়া ভিজেনি। রমজান মাস শুরুর আগেই উত্তপ্ত নিত্যপণ্যের বাজার।
সাধারণ ব্যবসায়ীরা মনে করেন, এক শ্রেণির অসাধু চক্র বা বাজার সিন্ডিকেট এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিনই কোনো না কোনো খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২২ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর আগের দিন গত শনিবারও কেজিতে দাম বাড়ে সাত-আট টাকা। সে হিসাবে গত শুক্রবারের পর অর্থাৎ তিন দিনে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে মধ্যবিত্তের পাতেও এখন আর উঠছে না গোশত। গরু-খাসি দূরে থাক; সোনালি ও কক ছেড়ে ব্রয়লার ধরেছিলেন তারা। এখন এটিও নাগালের বাইরে। যদিও নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ গোশতের স্বাদ ভুলেছেন অনেক আগেই। গত শুক্রবার প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
গতকাল সোমবার তা বিক্রি হয়েছে ২৮০ থেকে ২৯০ টাকা পর্যন্ত। বিক্রেতারা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় এমনিতেই মুরগির সংকট। তার ওপর গত দুদিনে বৃষ্টিতে সরবরাহ আরও কমেছে। এ কারণে বাজারে দাম বেড়ে গেছে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও তাদের কথায় উঠে এসেছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্রয়লার মুরগির বর্তমান দাম অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়তে বাড়তে এখন প্রতি কেজি প্রায় স্বাভাবিক দামের থেকে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। দেড় মাস আগেও প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির বাজার দর অনুযায়ী, রাজধানীতে গত ৩১ জানুয়ারি এক কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৪৫-১৬০ টাকা। আর গতকাল সংস্থাটির ওয়েবসাইটে পণ্যটির দাম ছিল ২৪০-২৬০ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকা। যদিও বাজারে দাম ২৯০ টাকা। সে হিসাবে বেড়েছে দ্বিগুণ। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সামপ্রতিক বছরগুলোতে এতটা বাড়তি দামে ব্রয়লার মুরগি কখনো বিক্রি হয়নি। ব্রয়লারের দাম বাড়ার কারণে এখন বেড়েছে সোনালি ও ককসহ দেশি মুরগির দামও। দেশি মুরগির দাম সাধারণের নাগালের বাইরে গেছে অনেক আগেই। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর কাপ্তান বাজার, কমলাপুর ও সেগুনবাগিচা বাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
কমলাপুরের ব্রয়লার বিক্রেতা নাহিদ জানান, রোববার রাতে কাপ্তানবাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ২০-২২ টাকা বেশি গেছে। আগের রাতে (শনিবার দিনগত রাত) বেড়েছে আরও পাঁচ-ছয় টাকা। সব মিলিয়ে শুক্রবারের পর সোমবার পর্যন্ত এ দাম কেজিতে ৩০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি। তিনি জানান, বাজারে সোনালি মুরগির দাম বেড়েছে এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৫০ থেকে ৮০ টাকার মতো। কয়েক সপ্তাহ আগে সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকায়। এখন সেটা ৩৮০-৩৯০ টাকা। টিকাটুলিতে দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৫০ থেকে ৫৭০ টাকায়। গত এক মাসে দেশি মুরগির দামেও বড় পার্থক্য হয়েছে। মাসখানেক আগেও দেশি মুরগির কেজি ৫০০ টাকার কমে পাওয়া যেত।
খামারিরা জানিয়েছেন, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও অনেক খামার বন্ধ হওয়ায় বাজারে ডিম ও মুরগির সংকট দেখা দিয়েছে। তাতে প্রকৃতপক্ষেই দাম কিছুটা বেড়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দাম আরও বাড়াচ্ছেন। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার গণমাধ্যমকে জানান, খাদ্য ও বাচ্চার মূল্যবৃদ্ধির ফলে মুরগির দাম বেড়েছে। তবে এখনকার দাম মাত্রাতিরিক্ত। এত বেশি দামে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হোক, সেটি আমরাও চাই না। কারণ প্রান্তিক খামারিরা বাড়তি দাম পাচ্ছেন না। এ মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। তারা প্রতিদিনের দাম নির্ধারণ করেন। বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রসঙ্গত, গতকাল বাজারে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা আর খাসির মাংস প্রতি কেজি এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।