- ৭০ বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির আইন মানছে না
- সীমাবদ্ধতা ও মানসম্মত প্রস্তাবনার অভাব বলছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
- গবেষণা আইন মানার পরিকল্পনাই নেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের
- আইন লঙ্ঘনের দায়ে ইউজিসি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে ইউজিসির আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন
—আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাবেক ভিসি, ঢাবি
গবেষণা ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উৎসাহিত করেছি
—ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র, সদস্য, ইউজিসি
উচ্চ শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য দক্ষ গবেষক তৈরি করা। শিক্ষা খাতে গবেষণার বিকল্প নেই, কারণ বিষয়ভিত্তিক গবেষণা না থাকলে নতুন কৌশল আবিষ্কার সম্ভব নয়। উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আইন রয়েছে। কিন্তু কার্যক্রম চলমান ৯৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৭০টিই ইউজিসির ন্যূনতম আইন মানছে না। এর মধ্যে এক টাকাও গবেষণায় ব্যয় করেনি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৭টি। যদিও গবেষণায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশি ব্যয় করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গবেষণায় ব্যয় করাকে অতিরিক্ত খরচ মনে করছে কর্তৃপক্ষ। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে গবেষণার জন্য বরাদ্দ চাচ্ছে। আবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মানসম্মত গবেষণা প্রস্তাবনা না পাওয়ায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ইচ্ছা থাকার পরও বরাদ্দ দিতে পারছে না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বাৎসরিক ব্যয়ে উদ্বৃত্ত রেখেও গবেষণায় ইউজিসি আইন মানার পরিকল্পনা নেই। গবেষণায় ইউজিসির আইন অমান্য করার ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গবেষণায় ব্যয় না করার ব্যাপারে ইউজিসিও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে ইউজিসি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
ইউজিসি আইন-২০১০ এ উল্লেখ রয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্রের শর্তাবলির ৯ ধারায় বলা হয়েছে, ধারা ৭ এর অধীন সাময়িক অনুমতিপ্রাপ্ত প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এই আইনের অধীন সনদপত্রের জন্য নিম্নবর্ণিত শর্তাবলি
পূরণ করতে হবে। ৭ শর্তের মধ্যে ৬ নং শর্ত হলো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক বাজেটের ব্যয় খাতে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত একটি অংশ গবেষণার জন্য বরাদ্দপূর্বক তা ব্যয় করতে হবে। ইউজিসি মোট ব্যয়ের ২ শতাংশ গবেষণায় খরচের নির্দেশনা দিয়েছে। ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয় এই আইন মানেনি। অথচ ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় বাৎসরিক কোটি টাকার উপরে ব্যয় করলেও গবেষণার জন্য এক টাকাও খরচ করেনি। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এগুলো হলো— ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। বার্ষিক ব্যয় ছয় কোটি ৩২ লাখ টাকা। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (তিন কোটি এক লাখ টাকা), প্রাইম ইউনিভার্সিটি (সাত কোটি ছয় লাখ টাকা), বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (আট কোটি ১৫ লাখ টাকা), আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (চার কোটি ৪০ লাখ), ফাস্ট ক্যাপিটেল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (তিন কোটি ৯৭ লাখ টাকা), জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চার কোটি ৭১ লাখ), নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (পাঁচ কোটি ৯৮ লাখ), বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (৩২ কোটি ৮৭ লাখ), দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স (চার কোটি ৮৬ লাখ), রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় (দুই কোটি ৫০ লাখ), সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এক কোটি ৩৭ লাখ), ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ (দুই কোটি ৭৫ লাখ), আনোয়ার খান মডার্ন ইউনিভার্সিটি (ছয় কোটি ৮৮ লাখ)। এ ব্যাপারে দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটির অব বাংলাদেশের ভিসি প্রফেসর আব্দুল মান্নান চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, গবেষণায় খরচ না করার বিষয়টি আমি জানি না। আমাদের ট্রেজারারের কাছ থেকে দেখতে হবে।আশা বিশ্ববিদ্যালয়েল ভিসি প্রফেসর ড. ডালিম বর্মন আমার সংবাদকে বলেন, ‘গবেষণায় খরচ না করার বিষয়টি আমি জানি না। আমাকে দেখতে হবে। একাডেমিক কার্যক্রম চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। অতিরিক্ত গবেষণায় ব্যয় করব কীভাবে? নিজস্ব টাকায় গবেষণায় খরচ করা কঠিন।’
বাৎসরিক খরচে উদ্বৃত্ত থাকলেও ৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত দুই শতাংশ ব্যয় করেনি। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় ১৮৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ব্যয় করেছেন, ১৬৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। অথচ গবেষণায় ব্যয় এক কোটি ১১ লাখ টাকা। যা মোট ব্যয়ের শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ ব্যাপারে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এম এম শহীদুল হাসান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা গবেষণার জন্য সর্বদা উদার। গবেষণার জন্য যারাই আমাদের কাছে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন তাদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে যে কেউ চাইলেই তো আমরা বরাদ্দ দিতে পারি না। আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখেছি, প্রকৃতপক্ষে কারা যোগ্যতা রাখে। এ গবেষণায় কত টাকা বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক আয় ৭৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ব্যয় ৬৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অন্য দিকে গবেষণায় ব্যয় ৪৬ লাখ ১৯ হাজার টাকা।
যা মোট ব্যয়ের শূন্য দশমিক ৭১২ শতাংশ।’ এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়টি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাসরুরুল মাওলা আমার সংবাদকে বলেন, ‘অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তো গবেষণায় ব্যয় করে না। আমরা যা ব্যয় করেছি তা নিজেদের অর্থায়নে করেছি। সরকারের পক্ষ থেকে গবেষণায় বাজেট থাকা প্রয়োজন। আগামীতে আরো ব্যয় করব।’ অন্যদিকে, গবেষণায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির আইন অনুযায়ী খরচ করেছে। এর মধ্যে সবার উপরে রয়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। এ প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা মোট খরচ করেছে ৫৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশের বেশি। আইন লঙ্ঘনের ব্যাপারে ইউজিসির কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ আইনের ১২ নং ধারায় বলা হয়েছে— সনদপত্র প্রাপ্তির জন্য ধারা ৯-এর কোনো শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে, ওই সাময়িক অনুমতিপত্র বা ক্ষেত্রমতো, নবায়নকৃত সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও শিক্ষা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
এ ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্বে থাকা ইউজিসির সদস্য ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র আমার সংবাদকে বলেন, ‘গবেষণায় ব্যয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা উৎসাহিত করেছি। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা সমান নয়। প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণায় কম খরচ মেনে নেয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা আইন মানার পরিকল্পনা থাকলে এমনটি হতো না।’ এ ব্যাপারে ইউজিসি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি-না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো ব্যবস্থা নেইনি। সম্প্রতি হাইকোর্ট এ ব্যাপারে সোচ্চার রয়েছে। আপাতত, ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবছি না।’ আইন মানায় তৎপর হওয়ার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের দেশে আইন লঙ্ঘনের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। যেকোনো আইন মানার ব্যাপারে আমাদের তৎপরতা থাকা উচিত। গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে ইউজিসি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।’