- দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের শঙ্কা
শীত শেষে আবারও জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। বাড়তে শুরু করেছে তাপমাত্রা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদাও। আসন্ন রোজা ও সেচ মওসুমে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে দুশ্চিন্তায় বিদ্যুৎ বিভাগ। এ সময়ের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মোকাবিলায় সর্বোচ্চ দুই হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি থাকবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। চলতি বছর শীতের মওসুমে প্রতিদিন গড়ে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করতে হয়েছে সারা দেশে। তার রেশ কাটতে না কাটতেই চলে আসছে গ্রীষ্ম। শীত শেষে এবার গ্রীষ্ম সামলানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ঢাকার বাইরে গ্রাম এলাকায় এখনই দুই-তিন ঘণ্টা লোডশেডিং চলছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে গ্রীষ্ম মৌসুমে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় লোডশেডিং আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড-আরইবির তথ্য বলছে, প্রতিদিন বর্তমানে সাতশ থেকে এক হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি থাকে। গত ১৫ মার্চ তাদের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ছয় হাজার ৫২৫ মেগাওয়াট। সরবরাহ করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৮২৮ মেগাওয়াট। অর্থাৎ সেদিন ৬৯৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং করা হয়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। এপ্রিলে ঘাটতির রেকর্ড হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংকটের অন্যতম কারণ অতিরিক্ত আমদানি-নির্ভরতা। গ্যাসের অনুসন্ধানে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হলে জ্বালানি খাত এতটা নাজুক পরিস্থিতির মুখে পড়ত না। দেশে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায়ও সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-বিপিডিবি বলছে, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা ৯ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট। এপ্রিলের দিকে এই চাহিদা এক লাফে ১৬ হাজারে পৌঁছাবে।
রোজা এবং কৃষকদের সেচ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এই চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াটেও পৌঁছাতে পারে। বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় সর্বোচ্চ উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ। আগামী এপ্রিলে চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুতের জোগান অনেকটাই কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, গ্রীষ্মে বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তীব্র গরম, পবিত্র রমজান ও সেচের কারণে এপ্রিলে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। দেশে তাপমাত্রা বাড়ছে। এরই মধ্যে শুরু হচ্ছে রোজা। দিনের ১৪ ঘণ্টা রোজা রেখে লোডশোডিং সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়বে। বাড়বে রোজাদারের কষ্ট। এদিকে বিদ্যুতের ঘাটতির ফলে শিল্পকারখানায় বিঘ্ন ঘটবে নিয়মিত উৎপাদন কার্যক্রমে। কৃষি উৎপাদনেও পড়বে বিরূপ প্রভাব। সব মিলে আগামী মাসের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই। সম্প্রতি বিদ্যুতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আলাপ হয় আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মেহাম্মদ হোসাইনের সাথে।
তিনি আমার সংবাদকে জানান, সামনে গরম বাড়বে। তাছাড়া বোরো ধানের মওসুমে সেচে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াটের চাপ থাকবে। আসন্ন রমজানেও বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। এতে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ চাহিদা থাকবে। তবে আশা করি আমরা ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারব। এতে আমাদের ঘাটতি সাড়ে তিন হাজার থাকে। এর মধ্যে রামপাল থেকে ১৩২০ মেগাওয়াট, বরিশালের পায়রা থেকে ৩৫০ মেগাওয়াট এবং ভারতের আদানি থেকে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাব। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের চাহিদার কাছিকাছি পৌঁছতে পারব। তিনি আরও বলেন, আমরা পেট্রোবাংলাকে জানিয়েছি, ১৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের দরকার হবে। এটা পুরোপুরি না পেলেও আমরা আশা করছি তার কাছাকাছি পাব। আমরা এখনই লোডশেডিংমুক্ত না হতে পারলেও একটা সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারব। স্বস্তি পাবে গ্রাহক।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম মনে করেন, ‘এখানে গ্যাসের স্বল্পতা হওয়া উচিত না। এখানে যথেষ্ট গ্যাস আছে। আমাদের এই সংকটের মূল কারণ হচ্ছে জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনা। আমি বলব, দেশে যে সাশ্রয়ী গ্যাসটা ছিল, যেটা আমাদের হাতে আছে- তা ব্যবহার করার যথেষ্ট চেষ্টা না করে আমরা ভুল পথে গেলাম। উচ্চমূল্যের এলএনজি আনলাম। এই নীতি না পাল্টালে আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।’
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য জ্বালানি (গ্যাস, তেল ও কয়লা) সরবরাহ নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। আগামী পাঁচ মাসে সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৬০০ কোটি ডলারের বেশি লাগবে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সব ধরনের জ্বালানি আমদানিতে মাসে গড়ে অন্তত ১২৫ কোটি ডলার লাগে। ইতোমধ্যেই এ চাহিদা সরকারকে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। এদিকে ডলার সংকটে আমদানি করা যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় জ্বালানি। ইতোমধ্যে ডলার ঘাটতির কারণে কয়লা আমদানি করতে না পারায় চলতি বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে এক মাস বন্ধ রাখতে হয়েছে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
কয়লার বিল বকেয়া রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে। পাঁচ মাসের বিল বকেয়া থাকায় জ্বালানি তেল আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে বেসরকারি খাতের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এদিকে ইতোমধ্যে সরকার এলএনজি আমদানি শুরু করেছে। এরপর থেকে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে ফিরেছে। এর আগে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এলএনজি আমদানি কমানো হয়েছিল। এতে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমে গিয়েছিল। এদিকে কয়লা আমদানির ধারাবাহিকতা সাপেক্ষে রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মোট ১৮০০ থেকে ১৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসতে পারে।
আর মাতারবাড়ী ও বরিশালের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫০০ থেকে ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর সঙ্গে সমপ্রতি যুক্ত হয়েছে ভারতীয় কোম্পানির আদানি গ্রুপের উৎপাদিত ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু এরপরও থেকে যাবে ঘাটতি। বস্তুত দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংকটের অন্যতম কারণ অতিরিক্ত আমদানি-নির্ভরতা।