শেয়ারবাজারের চারটি মিউচুয়াল ফান্ড বা তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎকারী সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনসের (ইউএফএস) মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন সনদ বাতিলেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএসইসির গত বৃহস্পতিবারের কমিশন সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভা শেষে বিএসইসির এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত ইউএফএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হামজা আলমগীর ও তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানটির সব পরিচালক, সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ ছাড়া ইউএফএসের নিবন্ধন কেন বাতিল করা হবে না, তার জন্য নোটিস দেয়া হবে। বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, চারটি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে সব মিলিয়ে প্রায় ২৩৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশ পালিয়ে গেছেন সৈয়দ হামজা আলমগীর। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ২৩৫ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মেলে। ২০১৮ সাল থেকে অল্প অল্প করে তহবিল থেকে অর্থ সরিয়ে নেন সৈয়দ হামজা আলমগীর। ভুয়া লেনদেন ও আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজির মাধ্যমে এ আত্মসাতের ঘটনা ঘটানো হয়।
দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প করে এ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলেও তহবিলগুলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান বা হেফাজতকারী প্রতিষ্ঠান যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে হেফাজতকারী প্রতিষ্ঠানের ‘হেফাজতের’ ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ দায়িত্বে ছিল সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-আইসিবি। হেফাজতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে আইসিবির তৎকালীন কর্মকর্তাদের কেন শাস্তি দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে আইসিবিকে চিঠি দেয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
এ ছাড়া তহবিলের আত্মসাৎ হওয়া অনাদায়ী অর্থ পুনরুদ্ধার ও পুনর্ভরণের জন্য বিশেষ নিরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আইসিবিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে তহবিলগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার দায়িত্বে থাকা নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান আহমেদ জাকের অ্যান্ড কোং, রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কোংসহ সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্ত প্রতিবেদনটি ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলে (এফআরসি) প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যত দিন এ বিষয়টির সুরাহা না হবে, তত দিন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তাদের অংশীদারদের পুঁজিবাজারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইউএফএস হচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নিবন্ধিত একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান।
যার অধীনে পাঁচটি মিউচুয়াল ফান্ড বা তহবিল পরিচালিত হয়। এসব তহবিলের আকার ৪৪০ কোটি টাকা। তহবিলগুলো হলো ইউএফএস পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস আইবিবিএল শরিয়াহ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস পদ্মা লাইফ ইসলামিক ফান্ড ও ইউএফএস প্রগতি লাইফ ইউনিট ফান্ড। এই পাঁচটি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে শেষটি বাদে বাকি চারটি তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে।
এর আগে অর্থ আত্মসাতের এ ঘটনায় বিএসইসির অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ইউএফএস ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে। যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব সাময়িকভাবে জব্দ করা হয়েছিল, সেগুলো হলো ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনস (ইউএফএস), ইউএফএস আইবিবিএল শরিয়াহ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ড, ইউএফএস পদ্মা লাইফ ইসলামিক ফান্ড, ইশরাত আলমগীর, সৈয়দা শেহরীন হুসাইন, সৈয়দ আলমগীর ফারুক চৌধুরী, মাহিদ হক, তারেক মাসুদ খান, আলিয়া হক আলমগীর, মোহাম্মাদ জাকির হোসেন, সৈয়দ হামজা আলমগীর, সৈয়দা মেহরীন রহমান ও মোসা. উম্মে ইসলাম সোহানা। বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত মূল ব্যক্তি সৈয়দ হামজা আলমগীর বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
শেয়ারবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডকে এক ধরনের নিরাপদ তহবিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থে গঠিত হয় এসব তহবিল। অন্যের টাকায় গঠিত তহবিলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগের নামে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের অর্থ নানাভাবে অপব্যবহার করেছেন সম্পদ ব্যবস্থাপকরা। এ কারণে মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারেই তলানিতে। নতুন করে ইউএফএসের এ ঘটনায় মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা আরও বাড়াবে বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।